সম্মান
ফজলে রাব্বী দ্বীন
জানালার ধারে টিয়েপাখিটা কেমন যেন ছটফট করছে। শনশনানি উড়ো বাতাসের তাণ্ডবলীলা ক্রমাগত বাড়ছে আর বাড়ছে। গাছের ওপর নুয়ে পড়া পাতাগুলো আর স্থির থাকছে না। উড়ে উড়ে গাছ থেকে মাটিমুখী হচ্ছে দিনদিন। কেমন যেন বিকট শব্দের ভয়ঙ্কর কিছু বস্তু এ দিকেই এগিয়ে আসছে। বিছানার ওপর হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা রিয়াদের নব্য ঘুমের বার্তাটা আর সত্যি হলো না। এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে
তাকাতেই দেখে হেলিকপ্টার। একদম নিচ দিয়ে বাঁশবাগানের ঠিক আধা হাত ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সেটা অদূরে কোথাও। রিয়াদের মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। দিনটাই যেন কেমন আজ। জানালার ধারে বসে থাকা টিয়েপাখিটার ভয় তখনো কাটেনি। গাছপালাগুলো এখনো শান্ত হয়নি। তবে সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কেননা হঠাৎ করে সদ্য ঝড়ের আভাস পাওয়া কল্পনা যে আর সত্য হলো না। রিয়াদ টিয়েপাখিটার দিকে হাত বাড়াতেই পাখিটা এক লাফে চলে এলো হাতে। তারপর সোজা কাঁধে। রিয়াদ পাখিটাকে অনেক দিন ধরে পোষে। অনেক কথাই সে বলতে পারে এখন। শুধু ভালোবাসার কথাকেই এখন পর্যন্ত পাখিটা আয়ত্তে আনতে পারল না। তবুও মনের অন্তরালে জমে থাকা ভালোবাসার কথাগুলো স্পষ্ট দেখতে পারে রিয়াদ। পাখিটি যখন রঙিন ঠোঁট খুলে মিষ্টি করে বলেÑ ‘শুভ সকাল’, তখন রিয়াদের বড় আনন্দ হয়। এমন আনন্দ যে কাউকে বলা যায় না কখনো। কিন্তু আজ পাখিটা এত মিষ্টি একটা সকালেও মুখ থেকে সেই ‘শুভ সকাল’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারল না। রিয়াদ একটু বিরক্তি বোধ করলেও কারণটি ঠিক বুঝতে পারল না।
পড়ালেখার জন্য রিয়াদ তার বাবা-মাকে ছেড়ে দূরের এক জেলা সিরাজগঞ্জ শহরে থাকে। পলিটেকনিক্যাল শহর থেকে তেমন দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। তা ছাড়া বাড়িতে তার বাবা রীতিমতো অসুস্থ বিধায় কোনো রকমে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালায়। মাঝে মধ্যে বাড়িতে হাজার দু-এক করে টাকাও পাঠাতে হয়। তবুও রিয়াদ সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। বন্ধুদের সাথে তেমনটি তার মেলামেশা নেই। কেমন যেন একা একা থাকতেই বড় পছন্দ। কলেজে ভালো ছাত্র বলে অনেক খ্যাতিও অর্জন করে ফেলেছে আজকাল। তবুও আজ দিনটি তার জন্য মোটেই সুখকর মনে হচ্ছে না। আগের তুলনায় উলট পালট লাগছে সব। টিয়েপাখিটা সেজন্যই হয়তো সকালবেলা ‘শুভ সকাল’ বলেনি। তা না বলে চুপটি করে কাঁধের ওপর বসে ছিল।
সকাল ৮টা। প্রতিদিনের মতো রিয়াদ টিউশনি করাতে হাফ মাইল দূরের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলো মীমদের বাড়ি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়–য়া মীম মেয়েটা হচ্ছে রিয়াদের ছাত্রী। যতটা সুন্দর গঠন আর সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হওয়া যায়, পড়ালেখার ব্যাপারে ঠিক ততটাই আবার ঘৃণা চলে আসে। মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। গোবর থাকলেও হয়তো হালকা কিছু ফসল ফলত, কিন্তু তার মাথায় তাও নেই। এত কষ্ট করে অঙ্ক বইটা প্রায় সাতবার করে রিভিশন দেয়া সত্ত্বেও ঠিক বার্ষিক পরীক্ষায় সাতের বেশি একটা নম্বরও সে পায়নি। রেজাল্টের লিস্ট দেখে মাথাটা যেন ঘোরাতে শুরু করল রিয়াদের। কী জবাব দেবে এখন মীমের বাবা-মাকে। হঠাৎ মীমের মা ও ঘর থেকে এ ঘরে এসেই একটা উড়ো খবরের বার্তা পড়া শুরু করে দিলো। সুন্দরী মীমের দিকে কুনজর পড়েছে রিয়াদের। সেজন্য ভালোভাবে না পড়িয়ে ছোট এই মেয়েটাকে প্রেমের জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছে, যা মীম নিজে তার মাকে বলেছে। রিয়াদের চোখে কঠিন এক অপমানের দৃশ্য। রেজাল্ট খারাপের দায়ভার বহন করতে হবে বলে মীম এত বড় একটা মিথ্যা ঘটনা সাজিয়েছে! ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো। পুরো এক মাসের টিউশনির সব টাকাই গচ্চা গেল। সেই আশায় বসে থাকার পাত্র নয় রিয়াদ। চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অন্য পথ ধরল সে। হঠাৎ পথিমধ্যেই বাড়ি থেকে ফোনে মিসকল এলো- বাবার জন্য টাকা লাগবে। এ দিকে তার পকেটে একটা টাকাও নেই। সকালবেলা বাড়িতে মাকে কল দিয়ে বলেছিল- টিউশনির সব টাকাই এবার পাঠিয়ে দেবে বাড়িতে। কিন্তু সব কিছুই ব্যর্থ হয়ে মেঘজমা আকাশের মতো হয়ে গেল। ছোট বোনের স্কুলে বেতন না দেয়া পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে পারবে না। ওদিকে ছোট ভাইটাও নিউমোনিয়ায় কষ্ট পাচ্ছে।
দেড়টা থেকে রিয়াদের সিমিস্টার পরীক্ষা শুরু। আকাশে জমা কয়েক টুকরো কালো মেঘ। সেই মেঘ যেন আকাশে নয়, মেঘগুলো আসলে রিয়াদের মনে। পরীক্ষার সব প্রস্তুতি চন্দ্রগ্রহণের মতো নিমিষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ টাকার একটা নোট শার্টের পকেটে আবিষ্কার করতে পেরে দেরি না করে অটোরিকশায় চড়ল। দৃষ্টিটা তার গাড়ির ভেতরের কাউকেই অবলোকন করল না। করুণ চাহনিটা বরং বাইরের দিকেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। এই সীমাবদ্ধতাই আরেকটা ছোট্ট অপরাধের প্রশ্ন জাগিয়ে তুলল, যখন সে কলেজের গেটের সামনে থামল। গাড়ির ভেতর পাশাপাশি সিটেই বসে থাকা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের মুখখানা একবারের জন্যও সে লক্ষ করেনি। রিয়াদের গায়ে কলেজের চকচকে ড্রেস। এক মুহূর্তেই চিনতে পারা ছেলেটিকে একটা ডাকও দেননি স্যার। মিষ্টি হাসির ছেলেটার মুখখানা গাড়ির ভেতর হঠাৎ মলিন দেখেও বুঝতে পারেননি স্যার। কিছু তো বলতেও পারা যেত! অথবা ধমকের সুরে সতর্কও করে দেয়া যেত। তাহলে মনের খবর কি তারা বোঝেন না? গায়ে ড্রেস পরা কলেজের একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রের মুখ থেকে সালামের উক্তি বের হলো না, এ কেমন ধরনের ছাত্র। প্রশ্নটি স্যারের মুখ থেকে বের হওয়াই স্বাভাবিক। তার পরও বাকিটুকু ইতিহাস।
ভাইস প্রিন্সিপালকে সামনাসামনি এমন একটা অসম্মানের জন্য রিয়াদকে তার মাথা নোয়াতে হলো শত শত ছাত্রছাত্রীর সামনে। ‘বেয়াদব’ শব্দটি তার কানের কাছে এখনো ঠাস ঠাস করে বাজে। চোখে ঝুলে থাকা সেই চশমা রাগ করে সে ভেঙে ফেলেছে। চারচোখা হয়েও যে পাশের ছিটে বসা স্যারকে দেখতে পারেনি আর সম্মান করতে পারেনি, তার আবার স্পষ্ট করে দুনিয়া দেখার কী প্রয়োজন? চশমাটা এক মোচড়ে ভাঙতে পারলেও শুধু ভাঙাতে পারেনি সেই অপরাধের নিষ্পাপ কিছু চিত্র, বোঝাতে পারেনি কাউকে তার মনের কথা। যৎসামান্য ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিতে পারে অনেকেই। কিন্তু রিয়াদের চোখে সেই যৎসামান্যই পাহাড়সম। একজন ভালো ছাত্র হিসেবে নিজেকে বড় ঘৃণিত বস্তু বলে মনে হয়। শুধু একটা সম্মান। এ কেমন বড় কঠিনতম কাজ? বাবা-মা কোনো দিন শিক্ষা দেয়নি নাকি? স্যারদের উক্তির সামনে নিরুত্তর রিয়াদ। তার পরও তার মন কথা বলে। নিজেকে ছেড়ে এবার জীবনের চেয়েও দামি মানুষদের নিয়ে কথা বলা মানুষদের কি বোধগম্য হয় না? কারণের বশেই তো দুনিয়া চলে! বাড়ি থেকে বারবার ফোনে মিসকল। বাবার বেহাল অবস্থা। কলেজ থেকে আজ আর হোস্টেলের দিকে রওনা হয়নি রিয়াদ। টিয়েপাখিটা হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করছে। বসে আছে কিছু না জানা শব্দ শেখার জন্য। কিন্তু রিয়াদের দৃষ্টিতে সবুজের অভাব। গাছের তলায় বসে বসে আকাশটা সে দেখছে। কী সুন্দর মুক্ত আকাশ। অথচ তার তলেই অসহায় মানুষেরা কত পরাধীন। কত নিয়মের বাধাই না জীবনকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারে! হঠাৎ আরেকটা নাটকের ধাপ। পেছন থেকে সেই মীম মেয়েটার মলিন কণ্ঠের মিষ্টি ডাক- ‘স্যার’।
মুখটা ঘোরাতেই রিয়াদ দেখতে পায় তার হাতে এক হাজার টাকার নোট। আর চোখে জমে ওঠা এক নদী জল। ঠিক রিয়াদের চোখের জলের মতো।
Comments
Post a Comment