মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত - মো. জোবায়ের আলী

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মো. জোবায়ের আলী
*************************

যেসব বিশিষ্ট লেখকের স্পর্শে বাংলা সাহিত্য ধন্য হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাদের অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুরের অন্তর্গত কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত। মা জাহ্নবী দেবী। বাংলা কাব্যে তিনিই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন।
মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় খিদিরপুর স্কুলে কিছু দিন পড়ার পর তিনি তদানীন্তন হিন্দু কলেজের (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) জুনিয়র বিভাগে ভর্তি হন। ১৮৪১ সালে তিনি এই কলেজের সিনিয়র বিভাগে প্রবেশ করেন। মেধাবী ও কৃতী ছাত্ররূপে তার সুনাম ছিল। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন।
মধুসূদনের চোখে তখন মহাকবি হওয়ার প্রবল স্বপ্ন। বিলেত যাওয়ার জন্য তিনি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। নামের শেষে যোগ করেন ‘মাইকেল’ যদিও শেষ অবধি তার সে সময় আর বিলেত যাওয়া হয়নি। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর পিতার রোষানলে পড়ে ত্যাজ্যপুত্র হলেন। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করায় একই বছর হিন্দু কলেজ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি শিবপুরস্থ বিশপস কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতি ভাষা রপ্ত করেন। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পর পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এক সময় পিতা তাকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন।
১৮৪৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধুসূদন জীবিকার অন্বেষণে মাদ্রাজ গমন করেন। সেখানে প্রথমে তিনি এক অনাথ আশ্রমে মাদ্রাজের অরফান মেইল আসাই লামের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান সামান্য বেতনে। ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই বিয়ে করলেন রেবেকা ম্যাকটা ভিশকে। রেবেকা ছিলেন শ্বেতাঙ্গিনী। তার পিতা-মাতার পরিচয়ও সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। মাদ্রাজেই কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাদ্রাজ থেকেই কবি শিখে নেন হিব্রু, ফরাসি, ইতালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা। এখান থেকেই তার প্রথম কাব্য ঞযব ঈধঢ়ঃরাব ষধফরব প্রকাশিত হয়। কবি এই বই প্রকাশ করতে গিয়ে ধারদেনাতেও পড়ে যান। এ সময় মাদ্রাজের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ‘ঝঢ়বপঃধঃড়ৎ’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। এ ছাড়া মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ভাষায় তার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
কলকাতায় জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে বহু বিচিত্র পেশা গ্রহণ করতে হয়। প্রথমে পুলিশ আদালতের করণিক ও পরে তিনি দোভাষীরূপে চাকরি করেন। ১৮৬২ সালে তিনি কিছুকাল কলকাতার ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পাদনারও কাজ করেন। এ বছর পিতার সম্পত্তি থেকে তার বেশ কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে এবং তিনি ১৮৬২ সালের ৯ জুন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত গমন করেন। ১৮৬৩ সালে তিনি স্বপরিবারে ফ্রান্স গমন করেন এবং সেখানকার ভের্সাই নগরীতে দিন যাপন শুরু করেন। সেখানে তিনি অর্থের তীব্র সঙ্কটে পড়েন। এ বিপদে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাকে অর্থ সাহায্য করেন। ১৮৬৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনের গ্রেজইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৬৭ সালের জানুয়ারি মাসেই দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
মধুসূদন নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন। এই সময় তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন রামনারায়ণ তর্করতেœর (১৮২২-১৮৮৬ খ্রি:) রতœাবলী (১৮৫৯ খ্রি:) নাটক। রামনারায়ণ তর্করতেœর রতœাবলীর ‘ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়েই মাইকেল মধুসূদন দত্ত সর্বপ্রথম বাংলা নাটকের সঙ্গে পরিচিত হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটকগুলো হলো- শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯ খ্রি:), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০ খ্রি:), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০ খ্রি:), পদ্মাবতী (১৮৬০ খ্রি:), কৃষ্ণ কুমারী (১৮৬১ খ্রি:) ও সর্বশেষ নাটক মায়াকানন (১৮৭২ খ্রি:)। এরপর তার রচিত হয় কাব্যÑ তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য (১৮৬০ খ্রি:) মেঘনাদ বধ প্রথম খণ্ড [মাকাব্য] (১৮৬১ খ্রি:), মেঘনাদ বধ দ্বিতীয় খণ্ড [মহাকাব্য] (১৮৬১ খ্রি:), ব্রজঙ্গনা কাব্য (১৯৬১ খ্রি:), বীরাঙ্গনা কাব্য [পত্রকাব্য] (১৮৬২খ্রি:) চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬ খ্রি:), হেক্টর বধ [গদ্য কাব্য] (১৮৭১ খ্রি:)। তিনিই বাংলায় প্রথম সনেট রচনা করেন এবং তার নাম দেন ‘চর্তুদশপদী’। ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ সর্বশেষ নাটক রচনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত এটি তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। এ ছাড়া তার একটি ইংরেজি নাটক জওতওঅ : ঊগচজঊঝঝ ঙঋ ওঘউঅ ১৮৪৯-৫০ সালে ইউরেশিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তার জীবন, দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আইন, ব্যবসায় তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। শেষ জীবনে মধুসূদন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখার্জির লাইব্রেরি ভবনে দ্বিতলে বসবাস করতেন। নাবালক ছেলেমেয়ের কথা ভেবে তার মন সর্বদাই কেঁপে উঠত। ছেলে মিল্টন ও আলবার্ট নেপোলিয়ন কি তাহলে অভুক্ত অবস্থায় মারা যাবে। আদরের দুলালি শর্মিষ্ঠার কী হবে।
মাত্র ৪৫ বছর বয়সে গলায় ঘাসহ অনেক জটিল রোগ বাসা বাঁধে মধুসূদনের দেহে। আদরের মেয়ের কথা চিন্তা করে অবশেষে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা মধুসূদন তেরো বছর বয়সী কন্যাকে পাত্রস্থ করলেন দ্বিগুণ বয়সী বেকার যুবক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের সঙ্গে।
১৮৭৩ সালের ২১ জুন মধুসূদন পরিবারসহ রোগজীর্ণ শরীর নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। আশ্রয় নিলেন আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে। এই হাসপাতালে কবি মাত্র আট দিন জীবিত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও বিনা চিকিৎসায় তার শরীর ক্রমেই জীর্ণ ও রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। হাসপাতালের চিকিৎসায় তার শরীর একটু উন্নতি হলেও ক্রমাগত গলার ব্যথা ও হৃদরোগসহ জটিল ব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত হলেন। মধুসূদন নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন শুনে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে লাগল। তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও পাদরিরা তাকে খ্রিষ্টান বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এ রকম সময়ই এলো স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যু সংবাদ। মধুসূদনের শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত আরো খারাপ হতে লাগল। একে একে তার বন্ধুরা রেভারেন্ট কৃষ্ণমোহন ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ দত্ত এসে হাজির হলেন হাসপাতালে তার অন্তিম মুহূর্তে।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রোববার বেলা ২টার সময় মহাকবি মধুসূদন দত্ত বন্ধু, জামাতা, পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর।
যেখানে চারদিন আগে তার প্রিয়তমা পত্নী হেনরিয়েটাকে সমাহিত করা হয়েছিল তার পাশে শোয়ানো হলো কবিকে। ১৮৭৩ সালের ৩০ জুন সেন্ট জেমস চার্চ-এর ধর্মযাজকের উদ্যোগে খ্রিষ্টীয় রীতি অনুযায়ী কলকাতা লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তার মরদহে সমাহিত করা হয়।
অলক্ষে উচ্চারিত হলো যেনো কবির শেষ সংলাপ ‘জীবনের কোন আশা পূর্ণ হয় নাই, অনেক আক্ষেপ লইয়া মরিতেছি, অনেক কথা আমার বলিবার আছে’।

Comments