রাত শেষে

শওকত নূর
----------------------------
/article/detail/3674

ভীষণ অন্ধকার এ পথটুকু। দু’পাশের ঘন গাছপালা মাথায় মাথায় ঠেস দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, আকাশ দেখা যায় না। মাস্টার সাহেব মৃদু গলা খ্যাঁকরে বললেন, কী ডাক্তার, হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে? অন্ধকারটা একটু বেশি। একটা টর্চ থাকলে ভালো হতো, ঠিক কি না? আকিব দুর্বল গলায় বলল, হুঁ। দেখতে পাচ্ছি না ভালো মতো। এ পথে আর কত দূর? মাস্টার সাহেব কিছু না বলে ছ্যাঁচ করে দেশলাইয়ে ঘা দিলেন। আলো জ্বলে উঠতেই দেখা গেল প্রশস্ত হালটের মতো নিচু ভেজা স্যাঁতসেঁতে পথের ওপর কুচকুচে কালো কী একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। গা শিউরে উঠল আকিবের। মাস্টার সাহেব সময় মতো দেশলাই না জ্বালালে কী ভয়ানক অবস্থা হতে পারত তেমন দৃশ্য কল্পনায় দেখতে লাগল সে। আলোটা নিমেষে নিভে গেছে। পা দিয়ে মাটিতে বার কয়েক আঘাত করলেন মাস্টার সাহেব। মুখে বললেন, এরা নাকি আবার কানে শোনে না। বুক দিয়ে নাকি শব্দ নেয়। দয়া করে এখন পথ ছাড়লে হয়।
খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবারো দেশলাই জ্বালালেন মাস্টার সাহেব। এবারে প্রাণীটার চোখে আলো পড়ায় সচকিত হলো সে। কুণ্ডলী ছাড়িয়ে আস্তে চলে গেল রাস্তার পাশের ঝোপের দিকে। মাস্টার সাহেব হাঁফ ছেড়ে বললেন যাক, আপদ দূর হলো। এসব সাপ সাধারণত খুব ভয়ানক হয়। গায়ে পা পড়লে কামড় বসাবেই। আর কামড় যদি মারল তো এক কামড়েই শেষ। শত ওঝার ঝাড়ফুঁকেও আর বাঁচার উপায় মেলে না। আকিব বিশেষ কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, আপনারা ওঝাতে বিশ্বাস করেন নাকি?
হুঁ। ওঝাই তো সাপে কামড়ের একমাত্র দাওয়াই। 
বলেন কী? কিন্তু এটা তো বিজ্ঞানসম্মত কিছু নয়। আকিব বলতে বলতে হোঁচট খেল। 
আরে ডাক্তার, কত কিছুই তো বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিজ্ঞান আর মানুষকে কতদূর সমস্যার সমাধান দিতে পারে? বিজ্ঞান যেখানে ব্যর্থ তন্ত্রমন্ত্রই সেখানে একমাত্র অবলম্বন, বুঝলেন? আকিব অস্ফুট বলল, সাপে কাটার বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে। ভেনম নামে ইনজেকশন জরুরি পুশ করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়। জানেন কি না?
মাস্টার সাহেব কথা বললেন না। অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে চললেন। থেকে থেকে মাটিতে শব্দ করতে লাগলেন পায়ে। কিছুক্ষণ চলার পর একটি উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। আকিবও দাঁড়িয়ে গেল। এবারে অন্ধকার খানিকটা হালকা লাগছে। আকিব ঊর্ধ্বে মুখ তুলে আকাশ দেখতে পেল। অগণিত তারা ফুটে আছে ঠিক মাথার ওপরে। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে পাহাড়ের মতো ঘন মেঘ থ মেরে আছে। শীতল হাওয়া বইছে। শ্রাবণ মাস। এমন মেঘ হাওয়া থেকে যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি উঠে আসতে পারে। বৃষ্টি শুরু হলে কেমন হবে ভাবতে লাগল সে। সম্মুখে দেখা যাচ্ছে বাড়িঘর বলতে কিছু নেই। মাস্টার সাহেব একটু আগে বলেছেন বেশ খানিকটা পথ এমনি ফাঁকা জায়গা দিয়ে যেতে হবে। যদি এরই মধ্যে বৃষ্টি এসে যায় তো কাকভেজা হয়ে মাস্টার সাহেবের বাড়িতে উঠতে হবে। বাড়তি কাপড়চোপড় নেই। কী হবে উপায় তেমনটি হলে?
হাঁটার ফাঁকে ঘন ঘন আকাশের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিল আকিব। মেঘগুলো খানিকটা সাদাটে আর বিস্তৃত হয়ে দ্রুত ঢেকে দিচ্ছিল একটু আগে দেখা যাওয়া তারার রাজ্যকে। বাতাসের বেগ বাড়ছে। ঘন ঘন বিজলীর আলোয় পথঘাট ক্ষণিকের জন্য হেসে উঠলেও পর মুহূর্তের দ্বিগুণ অন্ধকার চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে দিচ্ছিল।
আকিব ভাবল, মাস্টার সাহেবের নিশ্চয়ই এ ধরনের পথে হেঁটে অভ্যাস আছে। কিন্তু সে শহুরে যুবক। এ ধরনের পথে এমন পরিস্থিতিতে হাঁটার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ডাক্তারি পাস দিয়ে বিসিএস করে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে এ এলাকাতেই সে প্রথম যোগদান করেছে। মাস্টার সাহেবের সাথে পরিচয় হয়েছে মাস তিনেকের মতো হবে। ছোট ছোট দু’টি মেয়ে আছে তার। তাদের চিকিৎসায় এসেছিলেন এখানে। ভীষণ মিশুক, সরল ও গল্পপ্রিয় এ মানুষটা খুব সহজেই বশ করে ফেলেন তাকে। বয়সের অসমতা থাকলেও তারা বেশ বন্ধু এখন। আকিবের ব্যাচেলরস কোয়ার্টারে সময় সময় বন্ধুবৎসল এ লোকটি এসে তাকে বেশ সঙ্গ দিয়ে যান। গ্রামের নানা বিষয়ে গল্প শুনতে বেশ ভালো লাগে আকিবের। এমন বৃষ্টিভেজা অন্ধকার রাতে অন্য কোনো মানুষই এভাবে হয়তো এতটা দূরে নিয়ে যেতে পারত না তাকে। মাস্টার সাহেব তা পারছেন। তার চরিত্রের শক্তিশালী দিক এটা। তা ছাড়া তার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার হয়ে এমতাবস্থায় সম্পর্কের মূল্য অস্বীকার করার মতো ভাবলেশহীনতাও আকিবের নেই।
এবারে ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে প্রায় লোকালয়ে চলে এসেছে তারা। মাস্টার সাহেব কী ভেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। আকিব অন্ধকারেও টের পেল চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়েছে তার। তিনি ফিঁসফিঁসিয়ে বললেন, ডাক্তার, শুনুন, ওই যে সামনের ওই বাড়িটা খুব সাবধানে পেরোতে হবে।
কেন? আকিব উদ্বেগে জানতে চাইল। 
প্রশ্ন করবেন না। এখন উত্তর দেবার সময় নেই। যা বলছি তাই করুন। একদম পা টিপে টিপে এগোবেন। বিন্দুমাত্র শব্দ যেন না হয়। 
কোনো উচ্চবাচ্য না করে আকিব তার পেছন পেছন হাঁটতে থাকল। কাছাকাছি এসে ওই বাড়িটাকে দেখছে সে তীক্ষè চোখে। ভাবছে কী এমন বিষয়বস্তু নিহিত আছে বাড়ির মধ্যে যে, একে চোরের মতো নিশ্চুপ অতিক্রম করে যেতে হবে? ঘন গাছপালা ছাওয়া বাড়ি। বাইরের দিকে পথের গা ঘেঁষে একটা কুঁড়েঘর মতো দাঁড়ানো। কেউ জেগে আছে বলে মনে হয় না। একদম শান্ত, নিশ্চুপ। পা টিপে টিপে হাঁটছিল তারা। হঠাৎ কুঁড়েঘরের মধ্যে খটমট শব্দ হলো। কেউ জেগে উঠেছে নিশ্চয়ই। সেখান থেকে শব্দ ভেসে এলো, ক্যাঠায় যায়? কথা না কইয়া যায় ক্যাঠায়? আকিব ভাবল, মাস্টার সাহেব নিশ্চয়ই প্রতিউত্তর করবেন। কিন্তু তিনি কিছু না বলে আকিবের উদ্দেশে ফিঁসফিঁস করে বললেন, জবাব দেবেন না। দ্রুত পা চালান। কুইক!
আরো দ্রুত পা চালাল তারা। তখনই কুঁড়েঘরের মধ্যে চিৎকার উঠল, চোর! চোর! চোর যায়, চুরি কইরা। চোর ...। তুমূল চেঁচামেটিতে পিছু ধেয়ে আসছে কেউ। কিছুক্ষণের মধ্যে চিৎকারটা সমবেত শোরগোলে রূপ নিল। বেশ ক’জন যে একত্রে ছুটছে এরই মধ্যে তা বোঝা গেল। মাস্টার সাহেব এবার হাঁটা ছেড়ে দৌড়ালেন। মুখে বললেন, ডাক্তার, এবার দৌড়াও, প্লিজ। কুইক! হারামজাদা মোসলেম পাগলা টের পেয়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে দু’জন ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে। সামনে লোকালয়। তারা লক্ষ করল সেদিক থেকেও চোর চোর বলে লোকজন ধেয়ে আসছে। এবারে মাস্টার সাহেব নিজেও চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করলেন। সম্মুখ থেকে দৌড়ে আসা লোকগুলোকে অতিক্রম করে যেতেই তারা বলে উঠল, কই চোর? কই? কোন্ দিকে? মাস্টার সাহেব হাঁফিয়ে বললেন, এই তো এদিকেই আসছে। তারা বলল, আরে না না, এদিকে চোরটোর আসে নাই। আর চোর গেছে! দূর ছাই। রাত্রিবেলা ঘুম কামাই করে বেহুদা দৌড় ছুট! চলো সবাই।
বোঝা গেল চোর খোঁজায় ইস্তফা দিয়েছে লোকগুলো। কিন্তু দৌড় থামায়নি মাস্টার সাহেব আর আকিব। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা উঁচু এক আঙিনায় এসে উঠল। মাস্টার সাহেব এবার স্থির হয়ে হাঁফিয়ে বললেন, আর ভয় নেই। প্রায় এসে গেছি। ওই তো সামনের জংলা বাড়িটাই আমার। আকিব হাঁফিয়ে বলল, তা এখানে এসে আপনিও যে চোর চোর বলতে লাগলেন? 
এটা একটা কৌশল। 
মানে?
মানে হচ্ছে চোরদের যখন ধরা পড়ার উপক্রম হয় তখন জনগণকে ধোঁকা দিতে তারা নিজেরাও চোর, চোর, ধরো ধরো বলে দৌড়ায়। মানে মানুষ তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আর বুঝতে পারে না যে, যারা চোর চোর বলে দৌড়াচ্ছে তারা নিজেরাই চোর। এবার বুঝলেন?
হুঁ। কিন্তু আমরা তো চোর নই। তাহলে দৌড়ালাম কেন?
দৌড়ালাম, কারণ ব্যাটা মোসলেম হচ্ছে একটা বদমায়েশ পাগল। গভীর রাতে ঘরের বাইরে সামান্য শব্দ হলেও মনে করে চোর এসেছে। লাফিয়ে বাইরে আসে। তখন ওর হাতে থাকে আইখাওয়ালা বাঁশের লাঠি। সেটা গায়ে ঝাড়তে ও তো আর বিবেচনা করবে না কে চোর, কে ভদ্রলোক। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। 
হুঁ। কিন্তু এ যাবৎ কেউ কি তার হাতে ধরা পড়েছিল?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকজন। একজন চির পঙ্গুও হয়ে গেছে। 
সে কি চোর ছিল? 
না, সে পুলিশে চাকরি করত। সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ। এখন দোকানদারি করে। 
আলাপচারিতায় দু’জন মাস্টার সাহেবের বাড়ির উঠানে চলে এসেছে। উঠানের বাঁশে ভেজা পাট শুকাতে দেয়া আছে। উৎকট গন্ধে নাক চেপে ধরল আকিব। মাস্টার সাহেবের পেছন পেছন মাথা নিচু করে এগোল সে। একটা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন মাস্টার সাহেব। দরজায় কড়া নাড়লেন উপর্যুপরি। ভেতরে সাড়া শব্দ নেই। দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। দু’পা এগিয়ে দেশলাইয়ে ঘা দিলেন মাস্টার সাহেব। শূন্য বিছানা ভাসল চোখে। মাস্টার সাহেব চিন্তিত মনে বললেন, কই গেল? মেয়েদের ডাকলেন তিনি। ওপাশ থেকে ছোট ছোট দু’টি মেয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে দাঁড়াল। মাথা নিচু তাদের। 
তোর মা কই? জানতে চাইলেন মাস্টার সাহেব। 
বিছানায় তো ছিল। বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল তারা। 
কই? নাই তো বিছানায়, কই গেল? 
জানি না। 
আচ্ছা ডাক্তার, দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ? বসুন এসে। এখানে বসে বিশ্রাম করুন। অনেক কষ্ট গেছে। বিশ্রাম প্রয়োজন। আমি একটু বাইরে খোঁজ করি। অসুস্থ শরীরে যাবে কোথায় এত রাতে? ছাতা হাতে বেরিয়ে গেলেন মাস্টার সাহেব। 
বাতাসটা এখন পড়ে গেছে। তীব্র বিদ্যুতের ঝলক আর মেঘের গর্জনের সাথে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। মাস্টার সাহেব দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন। শরীর আধাভেজা। আগের চেয়েও বেশি বিমর্ষ লাগছে তাকে। গামছায় গা মাথা মুছতে মুছতে বললেন, মহাযন্ত্রণায় পড়া গেল। কী করব এখন ভেবে পাচ্ছি না। অসুস্থ মানুষ এ রাতে এই আবহাওয়ায় কই রইল? এমন তো হয় না কখনো। কী করি এখন? আকিব এবার মনোযোগী হয়ে বসল। ওনার অসুস্থতা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলবেন? সারা শরীরে তীব্র ব্যথা। এ ছাড়া আরো কোনো সমস্যা ? ব্যথাটাইবা কবে থেকে?
ব্যথাটা আজই প্রথম; তবে ...। 
তবে? আর কী সমস্যা?
আর যা সমস্যা তা মানসিক। 
কী ধরনের?
আবোলতাবোল কথা বলা কিংবা আচরণ করা!
কোনো কারণ জানা আছে কিছু?
হ্যাঁ। 
কী সেটা? কবে থেকে শুরু?
এই তো বছর খানেক হলো। এক সন্ধ্যায় বাথরুমে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে। 
কেন?
কেন তা বলেনি। শুধু বলেছে, এমনিতে ভয় পেয়েছে। আজ সন্ধ্যায় আবোলতাবোল বলার সাথে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। চিৎকার করতে থাকে। বাধ্য হয়ে ছুটে যাই আপনার কাছে। 
আচ্ছা গাঁয়ে আপনার কোনো আত্মীয়স্বজন আছে? বাড়িটা অবশ্য ফাঁকা। তবুও কোনো বংশধর?
না, গাঁয়ে কেউ নেই। ক’বছর হলো এখানে নতুন বাড়ি করেছি। 
বাড়িতে বহিরাগত কারো আসা যাওয়া?
হ্যাঁ, আছে। 
কে সে? কোথাকার?
একটা ছেলে। ওপাশের ফাঁকা বাড়িটা থেকে আসে। 
কী সম্পর্ক? কেন আসে?
ওকে মা বলে ডাকে। আমার মেয়েদের পড়ায়। 
কেমন মা?
এমনি পাতানো। আমার ছেলে সন্তান নেই।
এখনো কি আসে?
হ্যাঁ। 
তার সম্পর্কে কতদূর জানেন?
অভাবী। কলেজে পড়ে। এদিকে বাসরাস্তা রেলরাস্তা হওয়ার পর থেকে বাইরের খারাপের সাথে মেশে। আগে এমনটি ছিল না। 
আর কিছু?
মাঝে মাঝে টাকা পয়সা সাহায্য চায়। 
কার কাছে?
দু’জনেরই। তবে বুঝি আমার অগোচরে আমার স্ত্রীর কাছেই বেশি চায়। 
আচ্ছা কিছু মনে করবেন না। অচেনার মতো অনেক কিছু বলে ফেললাম। সাইকোলজি আমার বিষয় নয়। তবু চিকিৎসক হিসেবে কিছু সহপাঠ থাকে আমাদের। সে থেকেই প্রশ্নগুলো করা। ডোন্ট মাইন্ড। 
না, না, ডাক্তার, তা কেন? এতটা আপন আপনি আমার? কী মনে করব? আচ্ছা, রাত তো অনেক হলো। এবার বিশ্রাম নিন। চলুন ওপাশে বিছানা করা আছে। কত আর কষ্ট করে জেগে থাকবেন?
আপনি?
আমার আর ঘুম? এ চোখে ঘুম কী আর আসে? এভাবেই বসে থাকব সারা রাত। 
ঘুম আমারও হবে না। তারচেয়ে দু’জনেই জেগে থাকি। দেখি বৃষ্টি থামে কি না। থামলে না হয় দু’জন মিলে বাইরে খুঁজব। অকপট বলল আকিব।
বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। আরো বেশি গাঢ় হয়ে নামে। দু’জন বসে থাকে খাটে। মাঝে মাঝে দু’এক কথা হয়। আবার বন্ধ হয়ে যায়। বিজলীর ঝলক, বজ্রপাত, বাইরে গরু বাছুরের ডাক। একসময় আজান পড়ে। মাস্টার সাহেব অস্ফুট বলেন, রাত শেষ। অজু করে তিনি নামাজে বসেন। চার দিক ফর্সা হতে থাকে। বৃষ্টি এখন দম নিয়েছে। বাড়ির ওপাশে হঠাৎ কারা জোরে কথা বলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে কোলাহলে রূপ নিচ্ছিল তা। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। কী হয়েছে? কী হতে পারে? মোনাজাত শেষে ভাবছিলেন মাস্টার সাহেব। দুরু দুরু বুকে বাইরে পা বাড়ান তিনি। আকিব পেছনে। দ্রুত হেঁটে বাড়ির বার আঙিনায় যেতে অদূরের বাড়িটার নিচু জায়গায় বড় এক গাছের নিচে লোক জমায়েত দেখতে পায় তারা। দ্রুত হাঁটে তারা সেদিকে। ভিড়ের কাছে যেতে অকস্মাৎ কোলাহলটা প্রায় চুপসে যায়।
নিঃস্তব্ধতায় ভরকালেন মাস্টার সাহেব। আপাদমস্তকে কাঁপুনি টের পেলেন। ভিড়ের ফাঁক গলিয়ে তিনি দেখলেন দুটো নগ্ন পা ঝুলে আছে লম্বা গাছটার নিচু ডাল থেকে। নিচে পা ছুঁই ছুঁই করছে কাঠের এক টুল। পাশেই টিনের ছোট বাক্স। দ্রুত হাতে তার ডালাটা খুলে ফেললেন মাস্টার সাহেব। ভেতরে দুটি জিনিস পাওয়া গেল একটি নগ্ন ছবি। আত্মহননকারীর। সাথে ভাঁজ করা এক চিঠি। তাতে লেখা : আর কত জ্বালাতন করবি তুই, অমানুষ? কত টাকা তোর চাই? প্রতিদিন এত টাকায় কী কাজ হয়? সব কিছুর তো সীমা থাকে। আমি আর পারি না। তোর আঙিনায় এসে আমার জীবনটাই তোকে দিয়ে গেলাম। যে অস্ত্র দিয়ে দিনের পর দিন শেষ করলি তারও কপিটা দিয়ে গেলাম। আমার মৃত্যুর পর ওরকম আরো হাজার কপি তুলিস। আরো বেশি টাকা রোজগার করিস। বন্ধুবান্ধব নিয়ে উল্লাস করিস তুই। সুখে থাকিস। 
ইতি 
সানজিদা 
চিঠি পড়া শেষে মাস্টার সাহেব নগ্ন পা দু’টি ধরে চিৎকার দিলেন এ তুমি কী করলে, সনজু? কতবার তুমি বলেছ সে মহাপাপ, পরিণাম কালান্তরের নরকবাস। অথচ সেই তুমি...। কী হয়েছিল, কেন আমাকে খুলে বললে না? কত সমস্যাইতো পৃথিবীতে থাকে! তার সমাধানও থাকে। উহ্. ভাবতে পারি না আর। 
মাটিতে মাথা নোয়ালেন মাস্টার সাহেব। আকিব পাথরের মতো থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সে টের পেল তার গাল বেয়ে অশ্রু ফোঁটা ঝরছে।

Comments