৫২৫ বছর পরও কেন আমরা এপ্রিলের বোকা ?

জনকন্ঠ এর পাতা থেকে 

মিথ্যা কথা বলে বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পয়লা এপ্রিল বিবেচিত হলেও এই দিনটিতে লুকিয়ে আছে এক করুণ বিয়োগান্ত ঘটনার স্মৃতি, যা আজও অন্তরে দারুণ ব্যথার উদ্রেক করে।বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পরিচিত হলেও বস্তুত এ দিনটি হচ্ছে শোকের। আমরা জানি, স্পেনের গথিক রাজা রডারিকের জুলুম-নির্যাতন ও কুশাসনে সেখানকার প্রজাসাধারণ এতই পীড়িত অবস্থায় দিন গুজরান করছিল যে, তারা এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষাকারীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাজা রডারিক শুধু অত্যাচারীই ছিলেন না, তার চরিত্রও ছিল অত্যন্ত জঘন্য, এমনকি সিউটা দ্বীপের শাসনকর্তা কাউন্ট জুলিয়ানের সুন্দরী কন্যা ফ্লোরিন্ডার শ্লীলতাহানি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। অত্যাচারী ও লম্পট রাজা রডারিকের অপশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য, স্পেনের মানুষের স্বাধীনতা লাভের জন্য স্পেনের জনগণের পক্ষে কাউন্ট জুলিয়ান উমাইয়া খলিফা, ওয়ালিদের খিলাফতের পশ্চিম অঞ্চলের গবর্নর মূসা বিন নূসায়েরের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।
মূসা বিন নূসায়ের স্পেন দেশ থেকে এই আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে বীর সিপাহসালার তারিক ইব্নে যিয়াদকে ৪০০ সৈন্য, ১০০ ঘোড়া ভর্তি চারখানা রণতরীসহ স্পেনের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। তারিক সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন ভূখ-ের যে পর্বতের পাদদেশে অবতরণ করেন তার নামকরণ হয়ে যায় জাবালুত্ তারিক বা তারিকের পাহাড়, যা জিব্রালটার নামে স্প্যানিশ ভাষায় পরিচিত হয়।
তারিক এই স্থানটিতে একটি সুরক্ষিত সেনানিবাস স্থাপন করে অতিদ্রুত স্পেনের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করেন। আলজিরিয়াস প্রদেশে এসে পৌঁছলে সেখানকার প্রাদেশিক গবর্নর থিওডমিরকে পরাজিত করে তিনি আরও সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং বীর বিক্রমে রাজধানী টলেডোর দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে থাকেন। উত্তর স্পেনে বিদ্রোহ দমনরত রাজা রডারিক মুসলিম সেনাপতির স্পেন ভূখ-ে আগমনের খবর পেয়ে দ্রুত রাজধানীতে এসে এক লাখ বিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তারিক বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে তারিকের বাহিনীতে আরও সৈন্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূসা বিন নূসায়ের সৈন্য প্রেরণ করেন। মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বীর সিপাহসালার এগোতে থাকেন। রডারিক বারো লাখ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে গোয়াডিলট নদীর তীরে অবস্থিত মেডিনা সিডোনিয়া নামক স্থানে তারিক বিন রিয়াদের বাহিনীকে মোকাবেলা করতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ হয়। অতঃপর মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর জিহাদী তাকতের সামনে রডারিক টিকতে না পেরে পলায়ন করতে গিয়ে গোয়াডিলট নদীতে সৈন্যবাহিনীসহ ডুবে মারা যান।
এটা ছিল মুসলিম বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজয়। এর ফলে কারমোনা, ইসেজা, সিডোনা প্রভৃতি তারিকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ে স্পেনের সাধারণ জনগণ আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। তারা গথিক শাসনের করালগ্রাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হয়ে যায়। তারিক সম্পূর্ণ স্পেনকে স্বাধীন করার জন্য সেনাবাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে একটিকে কর্ডোভার দিকে, আর একটিকে মালাগার দিকে, একটিকে গ্রানাডা ও ইলভিয়ার দিকে পাঠালেন আর মূল বাহিনী নিয়ে তিনি গথিক রাজার রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হলেন।
প্রায় বিনা বাধায় সাধারণ জনগণের প্রচুর খোশ্ আম্দেদ লাভ করতে করতে মালাগা, কর্ডোভা, গ্রানাডা, টলেডোতে ৭১১ খ্রিস্টাব্দেই ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন হলো, স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত হলো। তারিক বিন যিয়াদের এই গৌরবময় সাফল্যের খবর পেয়ে সম্পূর্ণ স্পেনে বিজয়ের সুফল সংহত করার জন্য গবর্নর মূসা ইবনে নূসায়ের আঠারো হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে স্পেনে এসে উপস্থিত হলেন। মূসা এবং তারিকের সম্মিলিত বাহিনী একে একে সারগোসা, তেরাগোনা, এ্যারাগোনা, বারসিলোনা, লিওন, গ্যালিসিয়া প্রভৃতি প্রদেশে বিজয় অর্জন করে।
তাদের এই বিজয় পর্তুগাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, পর্তুগালের নাম হয় আল গারব অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চল।স্পেনে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই স্পেনে যে প্রকৃত স্বাধীনতার বিজয় নিশান উড্ডীন হলো তা ৭৮০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। স্পেনে মুসলিম শাসনের ফলে কেবলমাত্র স্পেনের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুর ক্ষেত্রেই এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করে। কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্পেনে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত। মানব প্রতিভার ও শিল্পকলার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ সাধিত হয়েছিল স্পেনে। আধুনিক সভ্যতার অনেক উপাদানই স্পেনে উদ্ভাবিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন গড়ে উঠেছিল স্পেনে, যেমন : কর্ডোভার মসজিদ, গ্রানাডার দারুল উসূদ বা সিংহপুরী, আলহামরা প্রাসাদ। এই আলহামরার মৌচাকের মতো মনোরম ঝাড় স্থাপত্য শিল্পে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। মুসলিম স্পেনে বহু বিজ্ঞানী, প-িত, সমাজবিজ্ঞানী, আবির্ভূত হন, যারা বিশ্ব জ্ঞানরাজ্যে আজও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইবনে হায়সম, আল-ইদ্রীসী, আবূ উবায়দুল্লাহ, আলবাকারী, ইবনে জুবায়ের ইবনে বতুতা, ইবনে খলদুন প্রমুখ। ইবনে খলদুনের পুরো নাম হচ্ছে আবদুর রহমান ইবনে খলদুন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের জনক বলা হয় ইবনে খলদুনকে। তার ইতিহাসগ্রন্থের মুকাদ্দামা বা ভূমিকা আধুনিক ইতিহাসের পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। আল বাকারী ও আল ইদ্রীসী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ ও ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে সর্বস্বীকৃত মনীষী। এ ছাড়াও আল মাজরিতী, আল জারকানী, ইবনে ফালাহ প্রভৃতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ হিসেবে অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য হন।
বিশ্বসভ্যতার তদানীন্তন কেন্দ্রস্থল মুসলিম স্পেনে পুনরায় করায়ত্ত করার লক্ষ্যে খ্রীস্টানরা অত্যন্ত সন্তর্পণে রিকনকয়েস্টা অর্থাৎ পুনর্দখল আন্দোলন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে এবং শাহী মহলে বিরোধের আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে। কয়েক শ’ বছর ধরে চলা এই ষড়যন্ত্র একে একে তাদের সিংহাসন দখলের পথ খুলে দিতে থাকে। একে একে তারা সব দখল করতে থাকে। শেষ দখলকার্যটি তারা সম্পন্ন করে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি সুলতান আবূ আবদুল্লাহর সঙ্গে কাস্তলার সম্রাট ফার্ডিনান্ডের ৬০ দিন মেয়াদী এক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৫টি শর্ত সংবলিত ওই চুক্তি অতি গোপনে সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও তা জানাজানি হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনী এবং শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের মধ্যে সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ এ জন্য ছড়িয়ে পড়ে যে, আবূ আবদুল্লাহ্ অযৌক্তিকভাবে মুসলিম শাসনের ক্ষতি সাধন করছেন। অত্যাচারী ফার্ডিনান্ড যদি ক্ষমতা পায় তাহলে স্পেনের স্বাধীনতা বিঘিœত হবে, সর্বস্তরের জনগণের ওপর নেমে আসবে শোষণ-নির্যাতন এবং অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। সেনা ছাউনিতে এবং নগরে নগরে বিক্ষোভের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আবু আবদুল্লাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজের জান বঁাঁচানোর জন্য চুক্তির ৬০ দিন পূর্ণ হতে না হতেই ফার্ডিনান্ডের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ফার্ডিনান্ড ক্ষমতা পেয়েই জনগণের বিক্ষোভের তোয়াক্কা না করে আলহামরা প্রাসাদে রানী ইসাবেলাসহ প্রবেশ করেন এবং আলহামরা প্রাসাদ চূড়ায় উড্ডীয়মান ইসলামী পতাকা নামিয়ে সেখানে ক্রুশ স্থাপন করেন। এরপর নেমে আসে অত্যাচার আর নির্যাতন, যা ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয় মুসলিমদের ওপর। হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করে প্রহসনমূলক বিচারের কাঠগড়ায় দঁাঁড় করিয়ে মুত্যুদ-ে দ-িত করা হতে থাকে এমনকি অনেককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
অতঃপর এক সাধারণ নির্দেশ জারি করা হয় যে, স্পেনে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিমকে খ্রীস্টান হতে হবে, যদি কেউ খ্রীস্টান না হয় তাহলে যেখানেই তাকে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। এই হুকুমনামা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণ নগর ত্যাগ করে পাহাড়-পর্বতে আত্মগোপন করতে লাগল। একটি মুসলিমও খ্রীস্টান হতে রাজি ছিল না। এ অবস্থা দেখে চতুর ফার্ডিনান্ড মুসলিম নিধনের এক নতুন কৌশল প্রয়োগ করল। ঘোষণা দেয়া হলো : যে সব মুসলিম জানমাল, পরিবার-পরিজন নিয়ে এ দেশ ছেড়ে ওপারের আফ্রিকায় যেতে চায় তাদের জন্য অনেক নৌজাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তাতে আরোহণ করলে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে ওপারে পৌঁছে দেয়া হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। এই ঘোষণা শুনে পাহাড়-পর্বতে, নিরাপদ স্থানে যারা লুকিয়েছিল সেই সব মুসলিম নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবাই জাহাজে গিয়ে উঠল। তাদের সঙ্গে কয়েক লাখ মূল্যবান গ্রন্থও ছিল। যথাসময়ে জাহাজ ছাড়ল। পয়লা এপ্রিল সকালবেলায় সবার অজান্তে খ্রীস্টান গুপ্তচররা জাহাজের তলা ফুটো করে দিয়ে অন্য জাহাজে করে পালাল, আর মুসলিমদের বহনকারী জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেল। সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। মূল্যবান সম্পদ ও গ্রন্থরাজি ডুবে গেল। সেই শোকের স্মৃতি, মুসলিম নিধনের করুণ স্মৃতিবাহী পয়লা এপ্রিল তামাশা করে বা মিথ্যার আশ্রয়ে বোকা বানাবার দিন হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে, এটা মানবতার জন্য অতি লজ্জাকর। যাকে মিথ্যা কথা বলে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তামাশা করা হয় তাকে বলা হয় এপ্রিল ফুল। এটার প্রবর্তন করা হয় ফ্রান্সের নবম চার্লস কর্তৃক ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ক্যালেন্ডারের সংস্কারকালে পয়লা এপ্রিলকে এপ্রিল ফুল ডে হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটা ইংল্যান্ডে বিস্তৃত হয় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ফ্রান্সে যাকে নিয়ে এই তামাশা করা হয় তাকে এপ্রিল ফিশও বলা হয় আবার স্কটল্যান্ডে বলা হয় এপ্রিল গাউক। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে আমাদের জন্মভূমি ছিনিয়ে নিয়ে এখানে ব্রিটিশ শাসনের বুনিয়াদ স্থাপন করে, এপ্রিল ফুলও আমাদের দেশে এসে যায়।
আমরা না জেনে, না বুঝে অনেক সময় ভিনদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করি, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকরই শুধু নয়, অপমানজনকও। অতএব, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, ইমান-আকিদা বিনষ্টকারী, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংসকারী কোন কিছু যত বেশি আমরা পরিহার করতে পারব, তত আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে, আমাদের স্বকীয়তা বিশ্ব দরবারে আমাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করবে।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
মিথ্যা কথা বলে বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পয়লা এপ্রিল বিবেচিত হলেও এই দিনটিতে লুকিয়ে আছে এক করুণ বিয়োগান্ত ঘটনার স্মৃতি, যা আজও অন্তরে দারুণ ব্যথার উদ্রেক করে।
বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পরিচিত হলেও বস্তুত এ দিনটি হচ্ছে শোকের। আমরা জানি, স্পেনের গথিক রাজা রডারিকের জুলুম-নির্যাতন ও কুশাসনে সেখানকার প্রজাসাধারণ এতই পীড়িত অবস্থায় দিন গুজরান করছিল যে, তারা এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষাকারীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাজা রডারিক শুধু অত্যাচারীই ছিলেন না, তার চরিত্রও ছিল অত্যন্ত জঘন্য, এমনকি সিউটা দ্বীপের শাসনকর্তা কাউন্ট জুলিয়ানের সুন্দরী কন্যা ফ্লোরিন্ডার শ্লীলতাহানি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। অত্যাচারী ও লম্পট রাজা রডারিকের অপশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য, স্পেনের মানুষের স্বাধীনতা লাভের জন্য স্পেনের জনগণের পক্ষে কাউন্ট জুলিয়ান উমাইয়া খলিফা, ওয়ালিদের খিলাফতের পশ্চিম অঞ্চলের গবর্নর মূসা বিন নূসায়েরের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।
মূসা বিন নূসায়ের স্পেন দেশ থেকে এই আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে বীর সিপাহসালার তারিক ইব্নে যিয়াদকে ৪০০ সৈন্য, ১০০ ঘোড়া ভর্তি চারখানা রণতরীসহ স্পেনের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। তারিক সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন ভূখ-ের যে পর্বতের পাদদেশে অবতরণ করেন তার নামকরণ হয়ে যায় জাবালুত্ তারিক বা তারিকের পাহাড়, যা জিব্রালটার নামে স্প্যানিশ ভাষায় পরিচিত হয়।
তারিক এই স্থানটিতে একটি সুরক্ষিত সেনানিবাস স্থাপন করে অতিদ্রুত স্পেনের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করেন। আলজিরিয়াস প্রদেশে এসে পৌঁছলে সেখানকার প্রাদেশিক গবর্নর থিওডমিরকে পরাজিত করে তিনি আরও সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং বীর বিক্রমে রাজধানী টলেডোর দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে থাকেন। উত্তর স্পেনে বিদ্রোহ দমনরত রাজা রডারিক মুসলিম সেনাপতির স্পেন ভূখ-ে আগমনের খবর পেয়ে দ্রুত রাজধানীতে এসে এক লাখ বিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তারিক বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে তারিকের বাহিনীতে আরও সৈন্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূসা বিন নূসায়ের সৈন্য প্রেরণ করেন। মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বীর সিপাহসালার এগোতে থাকেন। রডারিক বারো লাখ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে গোয়াডিলট নদীর তীরে অবস্থিত মেডিনা সিডোনিয়া নামক স্থানে তারিক বিন রিয়াদের বাহিনীকে মোকাবেলা করতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ হয়। অতঃপর মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর জিহাদী তাকতের সামনে রডারিক টিকতে না পেরে পলায়ন করতে গিয়ে গোয়াডিলট নদীতে সৈন্যবাহিনীসহ ডুবে মারা যান।
এটা ছিল মুসলিম বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজয়। এর ফলে কারমোনা, ইসেজা, সিডোনা প্রভৃতি তারিকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ে স্পেনের সাধারণ জনগণ আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। তারা গথিক শাসনের করালগ্রাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হয়ে যায়। তারিক সম্পূর্ণ স্পেনকে স্বাধীন করার জন্য সেনাবাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে একটিকে কর্ডোভার দিকে, আর একটিকে মালাগার দিকে, একটিকে গ্রানাডা ও ইলভিয়ার দিকে পাঠালেন আর মূল বাহিনী নিয়ে তিনি গথিক রাজার রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হলেন।
প্রায় বিনা বাধায় সাধারণ জনগণের প্রচুর খোশ্ আম্দেদ লাভ করতে করতে মালাগা, কর্ডোভা, গ্রানাডা, টলেডোতে ৭১১ খ্রিস্টাব্দেই ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন হলো, স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত হলো। তারিক বিন যিয়াদের এই গৌরবময় সাফল্যের খবর পেয়ে সম্পূর্ণ স্পেনে বিজয়ের সুফল সংহত করার জন্য গবর্নর মূসা ইবনে নূসায়ের আঠারো হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে স্পেনে এসে উপস্থিত হলেন। মূসা এবং তারিকের সম্মিলিত বাহিনী একে একে সারগোসা, তেরাগোনা, এ্যারাগোনা, বারসিলোনা, লিওন, গ্যালিসিয়া প্রভৃতি প্রদেশে বিজয় অর্জন করে।
তাদের এই বিজয় পর্তুগাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, পর্তুগালের নাম হয় আল গারব অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চল।
স্পেনে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই স্পেনে যে প্রকৃত স্বাধীনতার বিজয় নিশান উড্ডীন হলো তা ৭৮০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। স্পেনে মুসলিম শাসনের ফলে কেবলমাত্র স্পেনের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুর ক্ষেত্রেই এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করে। কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্পেনে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত। মানব প্রতিভার ও শিল্পকলার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ সাধিত হয়েছিল স্পেনে। আধুনিক সভ্যতার অনেক উপাদানই স্পেনে উদ্ভাবিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন গড়ে উঠেছিল স্পেনে, যেমন : কর্ডোভার মসজিদ, গ্রানাডার দারুল উসূদ বা সিংহপুরী, আলহামরা প্রাসাদ। এই আলহামরার মৌচাকের মতো মনোরম ঝাড় স্থাপত্য শিল্পে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। মুসলিম স্পেনে বহু বিজ্ঞানী, প-িত, সমাজবিজ্ঞানী, আবির্ভূত হন, যারা বিশ্ব জ্ঞানরাজ্যে আজও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইবনে হায়সম, আল-ইদ্রীসী, আবূ উবায়দুল্লাহ, আলবাকারী, ইবনে জুবায়ের ইবনে বতুতা, ইবনে খলদুন প্রমুখ। ইবনে খলদুনের পুরো নাম হচ্ছে আবদুর রহমান ইবনে খলদুন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের জনক বলা হয় ইবনে খলদুনকে। তার ইতিহাসগ্রন্থের মুকাদ্দামা বা ভূমিকা আধুনিক ইতিহাসের পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। আল বাকারী ও আল ইদ্রীসী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ ও ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে সর্বস্বীকৃত মনীষী। এ ছাড়াও আল মাজরিতী, আল জারকানী, ইবনে ফালাহ প্রভৃতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ হিসেবে অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য হন।
বিশ্বসভ্যতার তদানীন্তন কেন্দ্রস্থল মুসলিম স্পেনে পুনরায় করায়ত্ত করার লক্ষ্যে খ্রীস্টানরা অত্যন্ত সন্তর্পণে রিকনকয়েস্টা অর্থাৎ পুনর্দখল আন্দোলন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে এবং শাহী মহলে বিরোধের আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে। কয়েক শ’ বছর ধরে চলা এই ষড়যন্ত্র একে একে তাদের সিংহাসন দখলের পথ খুলে দিতে থাকে। একে একে তারা সব দখল করতে থাকে। শেষ দখলকার্যটি তারা সম্পন্ন করে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি সুলতান আবূ আবদুল্লাহর সঙ্গে কাস্তলার সম্রাট ফার্ডিনান্ডের ৬০ দিন মেয়াদী এক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৫টি শর্ত সংবলিত ওই চুক্তি অতি গোপনে সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও তা জানাজানি হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনী এবং শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের মধ্যে সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ এ জন্য ছড়িয়ে পড়ে যে, আবূ আবদুল্লাহ্ অযৌক্তিকভাবে মুসলিম শাসনের ক্ষতি সাধন করছেন। অত্যাচারী ফার্ডিনান্ড যদি ক্ষমতা পায় তাহলে স্পেনের স্বাধীনতা বিঘিœত হবে, সর্বস্তরের জনগণের ওপর নেমে আসবে শোষণ-নির্যাতন এবং অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। সেনা ছাউনিতে এবং নগরে নগরে বিক্ষোভের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আবু আবদুল্লাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজের জান বঁাঁচানোর জন্য চুক্তির ৬০ দিন পূর্ণ হতে না হতেই ফার্ডিনান্ডের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ফার্ডিনান্ড ক্ষমতা পেয়েই জনগণের বিক্ষোভের তোয়াক্কা না করে আলহামরা প্রাসাদে রানী ইসাবেলাসহ প্রবেশ করেন এবং আলহামরা প্রাসাদ চূড়ায় উড্ডীয়মান ইসলামী পতাকা নামিয়ে সেখানে ক্রুশ স্থাপন করেন। এরপর নেমে আসে অত্যাচার আর নির্যাতন, যা ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয় মুসলিমদের ওপর। হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করে প্রহসনমূলক বিচারের কাঠগড়ায় দঁাঁড় করিয়ে মুত্যুদ-ে দ-িত করা হতে থাকে এমনকি অনেককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
অতঃপর এক সাধারণ নির্দেশ জারি করা হয় যে, স্পেনে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিমকে খ্রীস্টান হতে হবে, যদি কেউ খ্রীস্টান না হয় তাহলে যেখানেই তাকে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। এই হুকুমনামা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণ নগর ত্যাগ করে পাহাড়-পর্বতে আত্মগোপন করতে লাগল। একটি মুসলিমও খ্রীস্টান হতে রাজি ছিল না। এ অবস্থা দেখে চতুর ফার্ডিনান্ড মুসলিম নিধনের এক নতুন কৌশল প্রয়োগ করল। ঘোষণা দেয়া হলো : যে সব মুসলিম জানমাল, পরিবার-পরিজন নিয়ে এ দেশ ছেড়ে ওপারের আফ্রিকায় যেতে চায় তাদের জন্য অনেক নৌজাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তাতে আরোহণ করলে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে ওপারে পৌঁছে দেয়া হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। এই ঘোষণা শুনে পাহাড়-পর্বতে, নিরাপদ স্থানে যারা লুকিয়েছিল সেই সব মুসলিম নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবাই জাহাজে গিয়ে উঠল। তাদের সঙ্গে কয়েক লাখ মূল্যবান গ্রন্থও ছিল। যথাসময়ে জাহাজ ছাড়ল। পয়লা এপ্রিল সকালবেলায় সবার অজান্তে খ্রীস্টান গুপ্তচররা জাহাজের তলা ফুটো করে দিয়ে অন্য জাহাজে করে পালাল, আর মুসলিমদের বহনকারী জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেল। সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। মূল্যবান সম্পদ ও গ্রন্থরাজি ডুবে গেল। সেই শোকের স্মৃতি, মুসলিম নিধনের করুণ স্মৃতিবাহী পয়লা এপ্রিল তামাশা করে বা মিথ্যার আশ্রয়ে বোকা বানাবার দিন হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে, এটা মানবতার জন্য অতি লজ্জাকর। যাকে মিথ্যা কথা বলে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তামাশা করা হয় তাকে বলা হয় এপ্রিল ফুল। এটার প্রবর্তন করা হয় ফ্রান্সের নবম চার্লস কর্তৃক ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ক্যালেন্ডারের সংস্কারকালে পয়লা এপ্রিলকে এপ্রিল ফুল ডে হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটা ইংল্যান্ডে বিস্তৃত হয় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ফ্রান্সে যাকে নিয়ে এই তামাশা করা হয় তাকে এপ্রিল ফিশও বলা হয় আবার স্কটল্যান্ডে বলা হয় এপ্রিল গাউক। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে আমাদের জন্মভূমি ছিনিয়ে নিয়ে এখানে ব্রিটিশ শাসনের বুনিয়াদ স্থাপন করে, এপ্রিল ফুলও আমাদের দেশে এসে যায়।
আমরা না জেনে, না বুঝে অনেক সময় ভিনদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করি, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকরই শুধু নয়, অপমানজনকও। অতএব, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, ইমান-আকিদা বিনষ্টকারী, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংসকারী কোন কিছু যত বেশি আমরা পরিহার করতে পারব, তত আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে, আমাদের স্বকীয়তা বিশ্ব দরবারে আমাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করবে।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ :উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)

৫২৫ বছর পরও কেন আমরা এপ্রিলের বোকা?

== আমরা কি এপ্রিলের বোকা?
==      কেন পালন করি “এপ্রিল ফুল”?
==      ৫২৫ বছর পরও কেন আমরা এপ্রিলের বোকা?

মীর আব্দুল আলীম, সময়ের কণ্ঠস্বর
সেই ৫ শ’ ২৫ বছর আগের কথা। ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল স্পেনে মোসলমানদের নিষ্ঠুর ভাবে বোঁকা বানানো হয়েছিলো। সেই দিনটি আমরা পালন করছি এখনও।
দঅঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষ’ অর্থ এপ্রিলের বোকা।
বোকা বানানোর দিবস। ধোঁকা দেবার দিন। এ দিনটিতে মিথ্যা বলে, কষ্ট দিয়ে কিংবা প্রতারণা করে হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তাই হয়ে আসছে দীর্ঘদিন।
প্রশ্ন হলো, দিবসটি এলো কি ভাবে?
কারা ছিল এপ্রিলের বোকা?
আমরাই বা কেন পালন করছি এ দিবসটি?
দিবসটি পালন মুসলমানদের জন্য কতুটুক যুক্তিক?
তবে কি না জেনে, না বুঝেই “এপ্রিল ফুল” পালন করছি আমরা?
যদি বলি এপ্রিল ফুল” মানেই মুসলমানদের বোকা বানানোর দিন; মুসলমানদের ধোকা দেবার দিন এটি?
হ্যাঁ ৫ শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে মুসলমানদের বোকাই বানানোই হয়েছিল এপ্রিলের এই দিনটিতে। তাহলে কেন পালন করছি এই দিনটি? এ দিবস আমাদের পালন করা কতটা হাস্যকর তা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
এপ্রিল ফুল মুসলিম ইতিহাসের এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাশ্চাত্যের কায়দায় মুসলিম দেশগুলোতেও প্রতি বছর কিছু লোক এপ্রিল ফুল ডে পালন করে যাচ্ছে অবলিলায়।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ বহু মুসলিম সে ইতিহাস ভুলে গিয়ে এপ্রিলের দিনটিকে স্বাচ্ছন্দে অংশ গ্রহণ করছেন এবং প্রচুর কৌতুক ও রসিকতা উপভোগ করছেন। সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। ইউরোপের বুকে খ্রিষ্টান বাহিনী ধোকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের মসজিদের ভেতর আটকে রেখে। পরে একযোগে শহরের সমস- মসজিদে আগুন লাগিয়ে ববর্র উল্লাসে মেতে ওঠে বিধর্মী হায়েনার দল । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে দিন স্পেনের কুখ্যাত ফার্ডিন্যান্ড আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদের চারি পার্শ্বে আগুন লাগিয়ে নৃশংসভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বাস ঘাতকতার পরিচয় দেয় এবং রক্তে রঞ্জিত করে গ্রানাডার রাজপথ এবং তাদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টান বানায়।
ফার্ডিন্যান্ড সে দিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ছিল “হায় মুসলমান! ুঅঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষচ তোমরা এপ্রিলের বোকা।” স্পেনীয়দের দ্বারা মুসলমানদের বোকা বানানোর এই নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকতা বা শঠতা স্মরণীয় রাখার জন্য খৃস্টান জগৎ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল খেলে থাকে রসিকতার খেলা, যে খেলা আমাদের কাছে বড় করুণের বড় বেদনার।
ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে না গেলে এপ্রিল ফুল কোনো মুসলিমকে আনন্দ দান করতে পারে না।
এখন আমরা কি পয়লা এপ্রিল হাসি-আনন্দের সাথে “এপ্রিল ফুল ডে” উদযাপন করব, নাকি ইউরোপের বুকে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মরণে দুঃখ অনুভব করব, মুসলিম ভাই-বোনেরা ভেবে দেখবেন কি?
এপ্রিল ফুল ডের এ মর্মানি-ক ইতিহাস জানারও পর কি আমরা এ দিনটিকে আমোদ-প্রমোদ কিংবা আনন্দের দিন হিসেবে পালন করতে পারি? কক্ষনোই না। এ দিনটি আসলে হওয়া উচিত আমাদের শোকের দিন, ইসলামের শত্রুদের চক্রানে-র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন। আরেকটা কথা। মানুষকে ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা এসব কিন’ ইসলামী আদশের্র পরিপন’ী।
১লা এপ্রিলে যেভাবে মিথ্যা বলে রসিকতা করার চেষ্টা করা হয় তা কোনভাবেই মুসলমানদের সংস্কৃতি
হতে পারে না। রাসূলে খোদা বলেছেন, “আমি রসিকতা করি ঠিক কিন’ কখনো মিথ্যা বলি না।” তিনি আরও বলেছেন, “ধ্বংস তার জন্য যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।” সুতরাং এপ্রিল ফুলের নামে আমরা কেউই কাউকে প্রতারণা করবো না এবং মিথ্যার আশ্রয় নেবো না-এই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার। কয়েক শ’বছর আগে ঘটনা। ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস’া কায়েমের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও।
অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে কায়েম হয় মুসলিম শাসন। মুসলমানদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে । দীর্ঘ ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা। স্পেনে মুসলমানদের ৮০০ বছরের গৌরবময় শাসনের ফলে দেশটিতে তখন অর্থসম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার।
মুসলমানরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা। নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের । এ দুর্বলতার সুযোগগ্রহণ করে খ্রিষ্টান জগত্‌। তারা মেতে উঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে ।
সিদ্ধান- নেয়, ‘স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে হবে।’ এ চিন-া নিয়েই পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম-বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্দিনান্দকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর দু’জন মিলে নেতৃত্ব দেন মুসলিম নিধনের । খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যাকরে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্ল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। এতদিনে টনক নড়ে মুসলিম বাহিনীর।
কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্দিনান্দ পা বাড়ায় ভিন্ন পথে। তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা । অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে । দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করলো তখন প্রতারক ফার্দিনান্দ ঘোষণা করলো, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস’ায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের বিনা রক্তপাতে
মুক্তি দেয়া হবে ।
সেদিন ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। দুর্ভাগ্য তাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে। শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়।
এরপর একযোগে শহরের সমস- মসজিদে আগুন লাগিয়ে ববর্র উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা । লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন- দগ্ধ হয়ে মর্মানি-কভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর।
প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলমানদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও
শোকাতুর করে তুলল তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা ! শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে ?’ সেই থেকে খ্রিষ্টান জগৎ
প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়াম্বরের সাথে পালন করে আসছে-“অঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষ” মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসব। দুঃখের সাথে বলতে হয় “এপ্রিল ফুল” এর প্রকৃত ইতিহাস সর্ম্পকে না জানার কারনে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের দুর্ভাগ্যকে আনন্দের খোরাক বানিয়ে এপ্রিল ফুল পালন করছি।
আমরা আর কতকাল আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকব ? নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সর্ম্পকে অজ্ঞতার ধরা আর কতদিন আমাদের মধ্যে বিরাজ করবে। অথচ এই অজ্ঞতাই আমাদের জন্য সবচেয়ে মারাত্নক কাল হয়ে দেখা দিয়েছে।
বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল গ্রানাডা ট্র্যাজেডির ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেনে আড়ম্বরপূর্ণ এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশ্ব খ্রিষ্ট সমপ্রদায়। সেখানে তারা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে একচ্ছত্র খ্রিষ্টীয় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে ‘হলি মেরি ফান্ড’। আর এরই ধারাবাহিকতায় গোটা খ্রিষ্টান বিশ্ব নানা অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে । অতএব সামনে ভয়াবহ দুর্দিন । এই দুর্দিনে এসব নব্য ইসাবেলাদের বিরুদ্ধে শানি-কামী শক্তির চাই সুদৃঢ় ঐক্য । আর যদি তা করতে ব্যর্থ হই তবে অচিরেই গ্রানাডার মতো বধ্যভূমিতে পরিণত হবে গোটা মুসলিম বিশ্ব।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট।
জনকন্ঠ এর পাতা থেকে
এপ্রিল ফুল পালন থেকে বিরত থাকার আহবান
সময়ের কনঠষস্বর
প্রথম আলোর ভূল উপাক্ষান
ব্লগ একাত্তরের চিল্লানি প্রথম আলোর সূরে

Comments