জন্মহীন মৃত্যুহীন অন্ধকারহীন আলোহীন
ফজল শাহাবুদ্দীন
কবিতা নিভৃতি এক ধ্যানমগ্নশব্দ লীলাখেলা’
কবিতা
সম্পর্কে এলিয়ট, ইয়েটস কিংবা জীবনানন্দ দাশ যেখানে থমকে
দাঁড়িয়েছেন, ঠিক সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছেন ফজল
শাহাবুদ্দীন। কবিতা তাঁর কাছে শুধু ধ্যানমগ্ন শব্দ লীলাখেলা হয়েই ধরা দেয়নি,
তিনি তার মধ্যে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন জীবনের সকল সক্রিয়
ধারাপাতকে। গোপন গভীর অভিসন্ধিগুলো টেনে আনতে চেয়েছেন অতিপ্রকাশ্যে আর এক নিপুণ
চাষি হয়ে কর্ষণে কর্ষণে উর্বর করে তুলতে চেয়েছেন চৈতন্যের নিরেট ভূমি।
পঞ্চাশের তীব্র ও তীক্ষè কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। একই দশকের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ কিংবা শহীদ কাদরীর পাশাপাশি যিনি সমান সক্রিয় এবং স্ব-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। আল মাহমুদ যেখানে নিসর্গ ও লোকসন্ধানী, শামসুর রাহমান সশব্দ নগরপ্রেমিক; সেখানে ফজল অনেকটাই আধ্যাত্মিক ও নিমগ্নচারী। যদিও তাঁর শুরুটা যৌবনকে ধারণ করে, উদ্দাম শরীরী প্রেম আর দেহজ অস্থিরতায় আক্রান্ত তাঁর প্রথম দিককার কবিতাগুলো রক্ষণশীল পাঠকমানসে ‘কামজ’ বিশেষণে চিহ্নিত ও উদ্ভাসিত, যার উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই কবি ও প্রবন্ধকার আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখায় ‘কালিদাসের মতো ফজল শাহাবুদ্দীন নিসর্গ ও নিসর্গের মধ্যে নারীর উন্মোচন ঘটিয়েছেন, আবিষ্কার করেছেন। ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে নারী ও যৌনতা, ক্রমে তার নানা খাত বদল হয়েছে। তার মধ্যে অনেক রকম আলোর বিস্তার, ছায়ার সঞ্চার। ডি এইচ লরেন্স বা বুদ্ধদেব বসুর মতো ফজল শাহাবুদ্দীনের শারীরিকতা তার আত্মার জিনিস।’
অবশ্য এর পরপরই কবি তাঁর কবিতার ক্ষেত্রভূমি প্রসারিত করেন। সেখানে যৌবনের পরিবর্তে স্থান পায় দেশকাল পারিপার্শ্বিকতা এবং সর্বোপরি মৃত্যু, বিধাতা এবং অবিনশ্বরতা। যা এই সত্তর পর্যন্ত কবিকে স্পর্শ করে আছে।
কবিতাঙ্গনে যে মুহূর্তে ফজলের আবির্ভাব, সে মুহূর্তটি তিরিশীয় ঘরানাকে অতিক্রম করে কবিতায় একটি নতুন আঙ্গিক এবং নতুন বিন্যাস তৈরির মুহূর্ত চল্লিশের ফররুখ আহমেদ কিংবা সৈয়দ আলী আহসান যার পথ প্রদর্শক, সে ধারাতেই এগিয়ে গেছেন তারুণ্যদীপ্ত ফজল শাহাবুদ্দীন এবং সব কিছুকে অতিক্রম করে তৈরি করে নিয়েছেন স্বকীয় একটি ধারা, একটি স্থান। নিজেকে আধুনিক কবি হিসেবে উল্লেখ করলেও তথাকথিত আধুনিকতা কিংবা উত্তরাধুনিকতা প্রশ্নে তাঁর অবস্থান অনেকটা কট্টর। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য-
‘আমাকে আধুনিকতা বলতে একেবারে আধুনিক গ্যাজেট-সমৃদ্ধ জীবন নিয়ে কবিতা লিখতে হবে কিংবা আমার কাব্যে একটি সচেষ্ট প্রয়াসের মধ্যে স্যুরিয়ালিজম বা এই ধরনের কোনো কিছুকে আনতে হবে, চিত্রকলায় যেভাবে আধুনিকতা এসেছে সেভাবে আনতে হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি আমার জীবন যেভাবে যাচ্ছে, আমার দেশ যেভাবে বড় হচ্ছে, আমার দেশের মানুষ যেভাবে জীবনধারণ করছে- তাকে একটি আধুনিক মননে ভঙ্গিতে প্রেক্ষিতে প্রকাশ করা উচিত এবং আমাদের কাব্যে, আমার বিশ্বাস যে, এই আধুনিকতা বিশেষভাবে উপস্থিত।’
(ভয়েজ অব জার্মানির কাছে দেয় সাক্ষাৎকার)
সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ফজল শাহাবুদ্দীন, যিনি প্রতিনিয়ত একটি নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণে ব্যস্ত। যে পৃথিবী বিধাতা সৃষ্ট অন্তরীক্ষকেও অতিক্রম করে যায়, যা আমাদের উন্মাদ করা জ্ঞানের মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকে ক্রমশ এক আত্মহননের প্রাসাদের মতো, যেখানে নীহারিকাপুঞ্জরা সুস্পষ্ট এবং ঘনিষ্ঠ এক বাগানের মতো। ফজল বিচরণ করতে চান সেই পৃথিবীতে; যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিশে আছে এক অঞ্চল বিন্দুতে এবং তা আন্দোলিত হচ্ছে এক ভাস্কর গাণিতিক নিয়মে। ফজল শাহাবুদ্দীন কবিতাকে মনে করেন একটি ইবাদত এবং তিনি তাতে নিমগ্ন হন আর আবিষ্কার করে চলেন একের পর এক অসম্ভব। সুন্দর সব শব্দরাজি আর সমৃদ্ধ করে তোলেন নিজ কবিতাভাণ্ডার।
ফজল শাহাবুদ্দীন নিঃসন্দেহে স্বপ্নচারী। তিনি কবিতা এবং বিধাতার কাছে সমর্পিত এক কাব্যপুরুষ, যিনি যেমন ভালোবাসেন জীবনকে, প্রেম ও প্রতিজ্ঞাকে- তেমনি স্পর্শ করতে চান স্রষ্টার গভীর সান্নিধ্য আর মৃত্যুর হিমশীতল চুম্বন। ফজল শাহাবুদ্দীনের মধ্যে কখনো কখনো নিজেকেও অতিক্রম করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রথমে কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’য় যে ফজলকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ‘আততায়ী সূর্যাপ্ত’ কিংবা ‘নিসর্গের সংলাপে’ তাকেই আবিষ্কার করি আরো গতিস্নান এবং ঋদ্ধ অবয়বে। ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন উপস্থাপনায় নিজেকে সমৃদ্ধ ও সাবলীল করার এই যে প্রবণতা- এর মধ্য দিয়েই একজন কবি সত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং নিঃসন্দেহে ফজল শাহাবুদ্দীন সেখানে সফল।
সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য কবিদের মতো জনপ্রিয়তার দৌড়ে শামিল হতে চান না তিনি এবং সে কারণেই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, প্রকাশকদের চেম্বারে অথবা বইমেলায় নেই তাঁর উপস্থিতি। টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সাহিত্য সভায় খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁকে। মঞ্চের চেয়ে লেখার টেবিলটিকে বেশি ভালোবাসা ফজল শাহাবুদ্দীনের সরব উপস্থিতি এখন শুধু তাঁর কবিতায়। ফজলের প্রিয় রমণী- তাঁর কবিতা। প্রিয় ইবাদত- তাঁর কবিতা। আর তাতেই নিমগ্ন থেকে তিনি পার করে দিচ্ছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ বসন্তগুলোকে। ‘বসন্তকালীন কবিতা উৎসবের মাধ্যমে বাংলা এবং বাংলা কবিতাকে দেশে এবং দেশের বাইরে জনপ্রিয় ও পরিচিত করার পাশাপাশি কবিতা এবং কবিদের একত্রিত করার একটা প্রয়াস এক সময় তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেলেও পারিপার্শ্বিকতার কারণে সে উৎসাহে এখন ভাটার টান। কবিতার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায় সৃষ্ট কবিতা পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’- দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তা পেলেও নানা কারণে তার ধারাবাহিকতা রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার প্রথম উচ্চারণ ‘ভালবাসা’। সে ভালোবাসা এককভাবে কোনো বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকে ঘিরে কখনো আবর্তিত হয়নি। বারবার বাঁক পরিবর্তনকারী ফজল নিজে কিন্তু স্থির থেকেছেন একটি স্থানেই। সে স্থানটি একাধারে আলোহীন এবং অন্ধকারহীন আর তার মধ্যে বসবাস করেছেন কবি একা, শুধু একা। একাকিত্বের যে সংজ্ঞাটি কবিচিত্তে দোলা দিয়েছে, তাতেই তিনি সমর্পিত হয়েছেন নিঃসঙ্কোচে। যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়ে, মহাকাশের জ্যোতিষ্ক মণ্ডল মেঘরাজি অন্তরীক্ষ বৃক্ষমালা নদী ও নারী এবং বিধাতাকে স্পর্শ করে যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন এক পরিণত ভূমণ্ডলে, তিনি নিজের মধ্যে কতটা একা, কতটা নিঃসঙ্গ তার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় ‘নিসর্গের সংলাপ’ কবিতাটিতে-
‘কখনো বা মনে হয় তুমি বুঝি অনন্তের নিসর্গ সোপান
ক্রমাগত বেঁচে থাকা মহাক্রন্দনের সেই অসম্ভব গান
অজস্ত্র মৃত্যুর মধ্যে জীবনের ঘনিষ্ঠ সুবাস
আমার পথের প্রান্তে ধুলোমাখা চৈতকুল চৈত্রের বাতাস
তুমি এলে মনে হয় মৃত্যু নেই কোনোদিন ছিল না বিলয়
তুমি ইহকাল পরকাল রূপরসগন্ধেভরা বেঁচে থাকা রক্ত মাংসময়।’
ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রথম দিককার কবিতায় ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমের একটা যুথবদ্ধ প্রয়াসের পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্কতার চিত্রও প্রস্ফুটিত। কেউ কেউ তাকে স্যুররিয়ালিজম হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও ফজল তার ঘোর বিরোধী। সম্ভবত সে কারণেই পরবর্তীকালে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় ক্রমাগত এক অপার্থিব প্রেম এবং পরলোক ও বিধাতাক্রান্ত অস্থিরতায়।
পঞ্চাশের তীব্র ও তীক্ষè কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। একই দশকের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ কিংবা শহীদ কাদরীর পাশাপাশি যিনি সমান সক্রিয় এবং স্ব-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। আল মাহমুদ যেখানে নিসর্গ ও লোকসন্ধানী, শামসুর রাহমান সশব্দ নগরপ্রেমিক; সেখানে ফজল অনেকটাই আধ্যাত্মিক ও নিমগ্নচারী। যদিও তাঁর শুরুটা যৌবনকে ধারণ করে, উদ্দাম শরীরী প্রেম আর দেহজ অস্থিরতায় আক্রান্ত তাঁর প্রথম দিককার কবিতাগুলো রক্ষণশীল পাঠকমানসে ‘কামজ’ বিশেষণে চিহ্নিত ও উদ্ভাসিত, যার উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই কবি ও প্রবন্ধকার আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখায় ‘কালিদাসের মতো ফজল শাহাবুদ্দীন নিসর্গ ও নিসর্গের মধ্যে নারীর উন্মোচন ঘটিয়েছেন, আবিষ্কার করেছেন। ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে নারী ও যৌনতা, ক্রমে তার নানা খাত বদল হয়েছে। তার মধ্যে অনেক রকম আলোর বিস্তার, ছায়ার সঞ্চার। ডি এইচ লরেন্স বা বুদ্ধদেব বসুর মতো ফজল শাহাবুদ্দীনের শারীরিকতা তার আত্মার জিনিস।’
অবশ্য এর পরপরই কবি তাঁর কবিতার ক্ষেত্রভূমি প্রসারিত করেন। সেখানে যৌবনের পরিবর্তে স্থান পায় দেশকাল পারিপার্শ্বিকতা এবং সর্বোপরি মৃত্যু, বিধাতা এবং অবিনশ্বরতা। যা এই সত্তর পর্যন্ত কবিকে স্পর্শ করে আছে।
কবিতাঙ্গনে যে মুহূর্তে ফজলের আবির্ভাব, সে মুহূর্তটি তিরিশীয় ঘরানাকে অতিক্রম করে কবিতায় একটি নতুন আঙ্গিক এবং নতুন বিন্যাস তৈরির মুহূর্ত চল্লিশের ফররুখ আহমেদ কিংবা সৈয়দ আলী আহসান যার পথ প্রদর্শক, সে ধারাতেই এগিয়ে গেছেন তারুণ্যদীপ্ত ফজল শাহাবুদ্দীন এবং সব কিছুকে অতিক্রম করে তৈরি করে নিয়েছেন স্বকীয় একটি ধারা, একটি স্থান। নিজেকে আধুনিক কবি হিসেবে উল্লেখ করলেও তথাকথিত আধুনিকতা কিংবা উত্তরাধুনিকতা প্রশ্নে তাঁর অবস্থান অনেকটা কট্টর। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য-
‘আমাকে আধুনিকতা বলতে একেবারে আধুনিক গ্যাজেট-সমৃদ্ধ জীবন নিয়ে কবিতা লিখতে হবে কিংবা আমার কাব্যে একটি সচেষ্ট প্রয়াসের মধ্যে স্যুরিয়ালিজম বা এই ধরনের কোনো কিছুকে আনতে হবে, চিত্রকলায় যেভাবে আধুনিকতা এসেছে সেভাবে আনতে হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি আমার জীবন যেভাবে যাচ্ছে, আমার দেশ যেভাবে বড় হচ্ছে, আমার দেশের মানুষ যেভাবে জীবনধারণ করছে- তাকে একটি আধুনিক মননে ভঙ্গিতে প্রেক্ষিতে প্রকাশ করা উচিত এবং আমাদের কাব্যে, আমার বিশ্বাস যে, এই আধুনিকতা বিশেষভাবে উপস্থিত।’
(ভয়েজ অব জার্মানির কাছে দেয় সাক্ষাৎকার)
সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ফজল শাহাবুদ্দীন, যিনি প্রতিনিয়ত একটি নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণে ব্যস্ত। যে পৃথিবী বিধাতা সৃষ্ট অন্তরীক্ষকেও অতিক্রম করে যায়, যা আমাদের উন্মাদ করা জ্ঞানের মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকে ক্রমশ এক আত্মহননের প্রাসাদের মতো, যেখানে নীহারিকাপুঞ্জরা সুস্পষ্ট এবং ঘনিষ্ঠ এক বাগানের মতো। ফজল বিচরণ করতে চান সেই পৃথিবীতে; যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিশে আছে এক অঞ্চল বিন্দুতে এবং তা আন্দোলিত হচ্ছে এক ভাস্কর গাণিতিক নিয়মে। ফজল শাহাবুদ্দীন কবিতাকে মনে করেন একটি ইবাদত এবং তিনি তাতে নিমগ্ন হন আর আবিষ্কার করে চলেন একের পর এক অসম্ভব। সুন্দর সব শব্দরাজি আর সমৃদ্ধ করে তোলেন নিজ কবিতাভাণ্ডার।
ফজল শাহাবুদ্দীন নিঃসন্দেহে স্বপ্নচারী। তিনি কবিতা এবং বিধাতার কাছে সমর্পিত এক কাব্যপুরুষ, যিনি যেমন ভালোবাসেন জীবনকে, প্রেম ও প্রতিজ্ঞাকে- তেমনি স্পর্শ করতে চান স্রষ্টার গভীর সান্নিধ্য আর মৃত্যুর হিমশীতল চুম্বন। ফজল শাহাবুদ্দীনের মধ্যে কখনো কখনো নিজেকেও অতিক্রম করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রথমে কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’য় যে ফজলকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ‘আততায়ী সূর্যাপ্ত’ কিংবা ‘নিসর্গের সংলাপে’ তাকেই আবিষ্কার করি আরো গতিস্নান এবং ঋদ্ধ অবয়বে। ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন উপস্থাপনায় নিজেকে সমৃদ্ধ ও সাবলীল করার এই যে প্রবণতা- এর মধ্য দিয়েই একজন কবি সত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং নিঃসন্দেহে ফজল শাহাবুদ্দীন সেখানে সফল।
সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য কবিদের মতো জনপ্রিয়তার দৌড়ে শামিল হতে চান না তিনি এবং সে কারণেই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, প্রকাশকদের চেম্বারে অথবা বইমেলায় নেই তাঁর উপস্থিতি। টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সাহিত্য সভায় খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁকে। মঞ্চের চেয়ে লেখার টেবিলটিকে বেশি ভালোবাসা ফজল শাহাবুদ্দীনের সরব উপস্থিতি এখন শুধু তাঁর কবিতায়। ফজলের প্রিয় রমণী- তাঁর কবিতা। প্রিয় ইবাদত- তাঁর কবিতা। আর তাতেই নিমগ্ন থেকে তিনি পার করে দিচ্ছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ বসন্তগুলোকে। ‘বসন্তকালীন কবিতা উৎসবের মাধ্যমে বাংলা এবং বাংলা কবিতাকে দেশে এবং দেশের বাইরে জনপ্রিয় ও পরিচিত করার পাশাপাশি কবিতা এবং কবিদের একত্রিত করার একটা প্রয়াস এক সময় তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেলেও পারিপার্শ্বিকতার কারণে সে উৎসাহে এখন ভাটার টান। কবিতার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায় সৃষ্ট কবিতা পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’- দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তা পেলেও নানা কারণে তার ধারাবাহিকতা রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার প্রথম উচ্চারণ ‘ভালবাসা’। সে ভালোবাসা এককভাবে কোনো বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকে ঘিরে কখনো আবর্তিত হয়নি। বারবার বাঁক পরিবর্তনকারী ফজল নিজে কিন্তু স্থির থেকেছেন একটি স্থানেই। সে স্থানটি একাধারে আলোহীন এবং অন্ধকারহীন আর তার মধ্যে বসবাস করেছেন কবি একা, শুধু একা। একাকিত্বের যে সংজ্ঞাটি কবিচিত্তে দোলা দিয়েছে, তাতেই তিনি সমর্পিত হয়েছেন নিঃসঙ্কোচে। যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়ে, মহাকাশের জ্যোতিষ্ক মণ্ডল মেঘরাজি অন্তরীক্ষ বৃক্ষমালা নদী ও নারী এবং বিধাতাকে স্পর্শ করে যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন এক পরিণত ভূমণ্ডলে, তিনি নিজের মধ্যে কতটা একা, কতটা নিঃসঙ্গ তার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় ‘নিসর্গের সংলাপ’ কবিতাটিতে-
‘কখনো বা মনে হয় তুমি বুঝি অনন্তের নিসর্গ সোপান
ক্রমাগত বেঁচে থাকা মহাক্রন্দনের সেই অসম্ভব গান
অজস্ত্র মৃত্যুর মধ্যে জীবনের ঘনিষ্ঠ সুবাস
আমার পথের প্রান্তে ধুলোমাখা চৈতকুল চৈত্রের বাতাস
তুমি এলে মনে হয় মৃত্যু নেই কোনোদিন ছিল না বিলয়
তুমি ইহকাল পরকাল রূপরসগন্ধেভরা বেঁচে থাকা রক্ত মাংসময়।’
ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রথম দিককার কবিতায় ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমের একটা যুথবদ্ধ প্রয়াসের পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্কতার চিত্রও প্রস্ফুটিত। কেউ কেউ তাকে স্যুররিয়ালিজম হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও ফজল তার ঘোর বিরোধী। সম্ভবত সে কারণেই পরবর্তীকালে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় ক্রমাগত এক অপার্থিব প্রেম এবং পরলোক ও বিধাতাক্রান্ত অস্থিরতায়।
আশ্চর্যজনক
হলেও সত্য যে, ফজলের এই পরিবর্তিত বিশ্বাসটিই তাঁকে মহৎ
কবিদের তালিকায় স্থান করে দিয়েছে।
‘কবিতা প্রকৃতি সেই সুবিশাল আদিঅন্তহীন
একটি বিন্দুর মতো যার মধ্যে আমি একা আছি
নির্মম জ্যোতির খেলা অন্ধকারে সীমানাবিহীন
জীবন মৃত্যুতে আমি যেতে চাই যার কাছাকাছি।’
ফজল শাহাবুদ্দীনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’। এ গ্রন্থটিতে কবি কিছুটা ভিন্নগামী। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এ দীর্ঘ সময়কে কবি খণ্ড খণ্ডভাবে ধারণ করেছেন এ গ্রন্থটিতে। দেশ এবং দেশের মানুষের বিপন্নতা এবং বিক্ষোভ ও সংগ্রামের চিত্রগুলো সৎ ও নির্ভীকভাবে উঠে এসেছে এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে।
‘বাংলাদেশ আগুন লাগা শহর
আর লক্ষ গ্রাম
বাংলাদেশ দূর্গময় ক্রুদ্ধ
এক ভিয়েতনাম।’
(বাংলাদেশ একাত্তরে)
কিংবা
‘রাইফেলধারী বেয়োনেটধারী শোনো
এবার তোমার রক্ত দেবার পালা
শাণিত তীক্ষè সাত কোটি হাতিয়ার।’
(নতুন ভিয়েতনাম)
এ সমস্ত রক্তঝরা পঙ্ক্তি একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কবি ফজলের এই পরিচয় এক বিশেষ পরিচয়, যা তাঁকে আলাদা মাত্রায় মাত্রায়িত করে।
ফজল শাহাবুদ্দীন সারাটা জীবন কবি, শুধুমাত্র একজন কবি হতে চেয়েছেন। আর এই আকাক্সক্ষাকে গোপন করার কোনো প্রয়াস তার মধ্যে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। বরং তারুণ্যদীপ্ত উচ্চারণে তিনি বারবার ঘটিয়েছেন এর স্বশব্দ প্রকাশ-
‘আমি ফজল শাহাবুদ্দীন
জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের অন্যনাম, কবি
এবং তারুণ্যে লেলিহান।’
ফজল শাহাবুদ্দীন যেভাবে জীবনকে ভালোবাসতে চান সেভাবে মৃত্যুকেও। কাউকে ছেড়ে কাউকে গ্রহণ করতে নারাজ এই কবি বসবাস করতে চান এ দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনো এক বিন্দুতে। কবির এই বসবাসকাল অনন্তের এ বাসে তাঁর একমাত্র সঙ্গী। অলৌকিক কবিতা আত্মা। কবির এ চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তারই একটি কবিতায়Ñ
‘একজন কবি এই জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক বিন্দুতে আশ্চর্য এক স্বপ্নের ভেতরে বসবাস করিতে লাগিল
কবি দেখিল
জীবন আছে থাকিবে চিরকাল মৃত্যু আছে বাঁচিবে অনন্তকাল
কবি তার একটি চোখের স্বপ্নে জীবনের আনন্দকে মাখিয়া নিল
করি তার একটি চোখের পানিতে মৃত্যুর মহিমাকে মিশাইয়া রাখিল
এবং কবি প্রার্থনা করিল
জীবন ও মৃত্যু একটি চিরকালের বিন্দুতে আসিয়া
একটি অচিন্তনীয় অবয়বে গ্রথিত হউক তার অস্তিত্বে তার চোখের জলে
এবং একজন কবি
সেই অবিশ্বাস্য বিন্দুতে বসবাস করিতে চাহিল চিরকাল।’
(জীবন মৃত্যু এবং একজন কবি)
জীবনানন্দ কিংবা বোদলেয়রকে ছুঁয়ে যে ফজলের যাত্রা, তার পরিণতি একমাত্র ফজলেই। যেখানে তিনি অদ্বিতীয়, অসাধারণ-
‘আমরা মরে গিয়ে কি বাতাসের
সংগে মিশে যাইমৃত্যু মানে কি এক জ্যোতির্ময়
অন্ধকার থেকে অন্য এক অন্ধকারময়
জ্যোতির দিকে নিঃসন্স একান্ত যাত্রায়।’
(মরণোত্তর রক্তকণিকায়)
‘কবিতা প্রকৃতি সেই সুবিশাল আদিঅন্তহীন
একটি বিন্দুর মতো যার মধ্যে আমি একা আছি
নির্মম জ্যোতির খেলা অন্ধকারে সীমানাবিহীন
জীবন মৃত্যুতে আমি যেতে চাই যার কাছাকাছি।’
ফজল শাহাবুদ্দীনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’। এ গ্রন্থটিতে কবি কিছুটা ভিন্নগামী। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এ দীর্ঘ সময়কে কবি খণ্ড খণ্ডভাবে ধারণ করেছেন এ গ্রন্থটিতে। দেশ এবং দেশের মানুষের বিপন্নতা এবং বিক্ষোভ ও সংগ্রামের চিত্রগুলো সৎ ও নির্ভীকভাবে উঠে এসেছে এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে।
‘বাংলাদেশ আগুন লাগা শহর
আর লক্ষ গ্রাম
বাংলাদেশ দূর্গময় ক্রুদ্ধ
এক ভিয়েতনাম।’
(বাংলাদেশ একাত্তরে)
কিংবা
‘রাইফেলধারী বেয়োনেটধারী শোনো
এবার তোমার রক্ত দেবার পালা
শাণিত তীক্ষè সাত কোটি হাতিয়ার।’
(নতুন ভিয়েতনাম)
এ সমস্ত রক্তঝরা পঙ্ক্তি একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কবি ফজলের এই পরিচয় এক বিশেষ পরিচয়, যা তাঁকে আলাদা মাত্রায় মাত্রায়িত করে।
ফজল শাহাবুদ্দীন সারাটা জীবন কবি, শুধুমাত্র একজন কবি হতে চেয়েছেন। আর এই আকাক্সক্ষাকে গোপন করার কোনো প্রয়াস তার মধ্যে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। বরং তারুণ্যদীপ্ত উচ্চারণে তিনি বারবার ঘটিয়েছেন এর স্বশব্দ প্রকাশ-
‘আমি ফজল শাহাবুদ্দীন
জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের অন্যনাম, কবি
এবং তারুণ্যে লেলিহান।’
ফজল শাহাবুদ্দীন যেভাবে জীবনকে ভালোবাসতে চান সেভাবে মৃত্যুকেও। কাউকে ছেড়ে কাউকে গ্রহণ করতে নারাজ এই কবি বসবাস করতে চান এ দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনো এক বিন্দুতে। কবির এই বসবাসকাল অনন্তের এ বাসে তাঁর একমাত্র সঙ্গী। অলৌকিক কবিতা আত্মা। কবির এ চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তারই একটি কবিতায়Ñ
‘একজন কবি এই জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক বিন্দুতে আশ্চর্য এক স্বপ্নের ভেতরে বসবাস করিতে লাগিল
কবি দেখিল
জীবন আছে থাকিবে চিরকাল মৃত্যু আছে বাঁচিবে অনন্তকাল
কবি তার একটি চোখের স্বপ্নে জীবনের আনন্দকে মাখিয়া নিল
করি তার একটি চোখের পানিতে মৃত্যুর মহিমাকে মিশাইয়া রাখিল
এবং কবি প্রার্থনা করিল
জীবন ও মৃত্যু একটি চিরকালের বিন্দুতে আসিয়া
একটি অচিন্তনীয় অবয়বে গ্রথিত হউক তার অস্তিত্বে তার চোখের জলে
এবং একজন কবি
সেই অবিশ্বাস্য বিন্দুতে বসবাস করিতে চাহিল চিরকাল।’
(জীবন মৃত্যু এবং একজন কবি)
জীবনানন্দ কিংবা বোদলেয়রকে ছুঁয়ে যে ফজলের যাত্রা, তার পরিণতি একমাত্র ফজলেই। যেখানে তিনি অদ্বিতীয়, অসাধারণ-
‘আমরা মরে গিয়ে কি বাতাসের
সংগে মিশে যাইমৃত্যু মানে কি এক জ্যোতির্ময়
অন্ধকার থেকে অন্য এক অন্ধকারময়
জ্যোতির দিকে নিঃসন্স একান্ত যাত্রায়।’
(মরণোত্তর রক্তকণিকায়)
মৃত্যু
মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু সেই পরিণতিতে সমর্পিত হয়েও অন্য এক জীবনের
স্বপ্ন,
অন্য এক জ্যোতির দিকে সঙ্গীহীন ধাবমানতার ইঙ্গিত একমাত্র ফজল
শাহাবুদ্দীনেই দৃশ্যমান। এখানেই ফজলের স্বাতন্ত্র্য, ফজলের
চিন্তার পরিপূর্ণতা।
সত্তর জন্মদিনের প্রাক্কালে জন্মহীন মৃত্যুহীন আলো অন্ধকারের এ বাসিন্দাকে অভিনন্দন-ভালোবাসা।
সত্তর জন্মদিনের প্রাক্কালে জন্মহীন মৃত্যুহীন আলো অন্ধকারের এ বাসিন্দাকে অভিনন্দন-ভালোবাসা।
Comments
Post a Comment