গুপ্তচরের জীবন মৃত্যু:রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনী
মূল : মাইকেল বার-জোহার ও নিশাম মিশালভাষান্তর : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
মাই ডিয়ার নাদিয়া, মাই ডিয়ার ফ্যামিলি,
তোমাদের কাছে এটাই আমার শেষ কথা। আশা করি, তোমরা চিরকাল একসাথে থাকবে। প্রিয় বউ আমার, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, শরীরের যত্ন নিয়ো এবং আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়ো।... প্রিয়তমা, তুমি চাইলে আবার বিয়ে করতে পারো, যাতে আমাদের সন্তানরা একজন বাবা পায়। এ ব্যাপারে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। অতীতের জন্য শোক কোরো না, বরং ভবিষ্যতের পানে তাকাও। আমার শেষ চুম্বন নিয়ো।
প্লিজ, আমার বিদেহি আত্মার জন্য প্রার্থনা কোরো।
তোমারই, এলি।
তোমারই, এলি।
১৯৬৫ সালের মে মাসে চিঠিটি মেইর অ্যামিতের নিউ রামসাদের ডেস্কে পৌঁছায়। চিঠির লেখক এলি কোহেন, গুপ্তরচরবৃত্তির ইতিহাসের অন্যতম দুর্ধর্ষ স্পাই। কাঁপা হাতে যখন সে চিঠিটি লিখছিল, তখন ফাঁসির মঞ্চ তার জন্য নীরবে অপেক্ষা করছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই তার আয়ু শেষ হয়ে যাবে।
এলির গুপ্তচর জীবন শুরু হয় তারও ২০ বছর আগে। ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের গনগনে দুপুরে সুদর্শন এক মিসরীয় যুবক বাড়ি ফিরছিল। মাঝারি উচ্চতা, ঠোঁটের ওপর মানানসই কালো গোঁফ, মৃদু হাসিমাখা মুখ। ফিরতে ফিরতে কায়রোর রাজপথে তার সাথে দেখা এক বন্ধুর। বন্ধুটি পুলিশ অফিসার। সে এলিকে ফিসফিস করে বলে, ‘জানো, আজ রাতেই আমরা কয়েকজন ইসরাইলি টেররিস্টকে গ্রেফতার করব। ওদের একজনের নাম স্যামুয়েল অ্যাজার।’ পুলিশ বন্ধুর কথা শুনে শুকনো হাসি হাসে এলি। এর একটু পরেই তার কাছ থেকে বিদায় নেয় এবং প্রায় দৌড়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঢোকে। ঢুকেই সে তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে হ্যান্ডগান, বিস্ফোরক ও অন্যান্য কাগজপত্র বের করে নেয়। সে যে গোপন কর্মকাণ্ডে জড়িত এগুলো তারই জিনিস। কার্যক্রমের নাম ল্যাভন অ্যাফেয়ার্স। এলি ভাবে, এবার পালাতে হবে। সে ইসরাইলে চলে যেতে ইচ্ছুক কিছু ইহুদি পরিবারের নামে কিছু ভুয়া কাগজপত্রও বানিয়ে ফেলে।
১৯৬৫ সালে ইসরাইলের নেতারা জানতে পারেন যে, ব্রিটিশ সরকার মিসর থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিসর হচ্ছে আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, আবার ইসরাইলের চরম শত্রু। দেশটিতে ব্রিটেনের সৈন্য মোতায়েন ছিল। সুয়েজ খালের পাড় ঘেঁষে ছিল বেশ কিছু সেনা ও বিমানঘাঁটি। এই সুবাদে মিসর শাসনকারী সামরিক জান্তার ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব খাটাতে পারত ইসরাইল। এখন ব্রিটিশরা না থাকলে সেই প্রভাবও আর থাকবে না ইসরাইলের। এ ছাড়া ব্রিটিশদের আধুনিক সেনাঘাঁটি, বিমানক্ষেত্র এবং বিপুল যুদ্ধসরঞ্জামও মিসরীয় বাহিনীর হাতে গিয়েই পড়বে। ছয় বছর বয়সী ইসরাইল তখন তার চেয়ে বড় ও সুসজ্জিত মিসরীয় সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হতে পারে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের স্বাধীনতাযুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হেরে যায় মিসরীয় সেনাবাহিনী। এবার তারা তার প্রতিশোধ নিতে চাইবে না!
১৯৬৫ সালে ইসরাইলের নেতারা জানতে পারেন যে, ব্রিটিশ সরকার মিসর থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিসর হচ্ছে আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, আবার ইসরাইলের চরম শত্রু। দেশটিতে ব্রিটেনের সৈন্য মোতায়েন ছিল। সুয়েজ খালের পাড় ঘেঁষে ছিল বেশ কিছু সেনা ও বিমানঘাঁটি। এই সুবাদে মিসর শাসনকারী সামরিক জান্তার ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব খাটাতে পারত ইসরাইল। এখন ব্রিটিশরা না থাকলে সেই প্রভাবও আর থাকবে না ইসরাইলের। এ ছাড়া ব্রিটিশদের আধুনিক সেনাঘাঁটি, বিমানক্ষেত্র এবং বিপুল যুদ্ধসরঞ্জামও মিসরীয় বাহিনীর হাতে গিয়েই পড়বে। ছয় বছর বয়সী ইসরাইল তখন তার চেয়ে বড় ও সুসজ্জিত মিসরীয় সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হতে পারে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের স্বাধীনতাযুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হেরে যায় মিসরীয় সেনাবাহিনী। এবার তারা তার প্রতিশোধ নিতে চাইবে না!
ব্রিটেনের সিদ্ধান্তটি কি বদলানো যায়? এদিকে বেন-গুরিয়ন আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেই। তিনি অবসরে গেছেন। তার জায়গায় এসেছেন মোশে শ্যারেত। শ্যারেত মানুষ হিসেবে উদারপন্থী, নেতা হিসেবে দুর্বল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিনহাস ল্যাভন তো তার নেতৃত্বকে প্রকাশ্যেই চ্যালেঞ্জ করেন। প্রধানমন্ত্রী বা মোসাদ কাউকেই কিছু না জানিয়ে তিনি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের (অ্যামন) প্রধান বেনইয়ামিন গিবলিকে নিয়ে একটি পরিকল্পনা করে ফেললেন; বিপজ্জনক ও বোকামিতে ভরা পরিকল্পনা। তারা ব্রিটেন-মিসর চুক্তিতে একটি ভুয়া ধারা বানিয়ে ফেললেন, যাতে বলা হয়, ‘গুরুতর পরিস্থিতি’র উদ্ভব হলে ব্রিটেন তার সাবেক সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ফিরে আসতে পারবে।
এরপর তারা দু’জন মিসরে সে রকম পরিস্থিতি কিভাবে তৈরি করা যায়, ভাবতে বসলেন। সিদ্ধান্ত হলো, যদি এমন বেশ ক’টি সন্ত্রাসবাদী বোমা হামলা করা যায় যা মিসরকে কাঁপিয়ে দেবে, তাহলে ব্রিটেন বুঝবে যে, মিসর সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না এবং সেক্ষেত্রে তারা দেশটি থেকে সৈন্য ও ঘাঁটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করবে।
ল্যাভন ও গিবলি সিদ্ধান্ত নিলেন, কায়রো ও আলেক্সান্দ্রিয়ার বেশ কিছু স্থানে বোমা হামলা চালানো হবে। হামলার লক্ষ্যস্থল হবে ব্রিটিশ ও আমেরিকান লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সিনেমা হল, ডাকঘর ও অন্যান্য সরকারি ভবন।
ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (অ্যামন) কাজে নেমে পড়ল। মিসরে তাদের সিক্রেট এজেন্টরা স্থানীয় কিছু তরুণ ইহুদিকে নিয়োগ দিলো। কট্টর ইহুদিবাদী এসব তরুণ ইসরাইলের জন্য জীবন দিতেও রাজি। এই কাজটি করে অ্যামন কিন্তু ইসরাইলের গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান লঙ্ঘন করে বসল। বিধানটি হলো : বিদেশে রক্তক্ষয়ী অভিযানে কোনোভাবেই স্থানীয় ইহুদিদের জড়ানো যাবে না। এতে তাদের কারো কারো প্রাণ যেমন যেতে পারে, তেমনি গোটা ইহুদি সম্প্রদায়ও পড়তে পারে মহা বিপদের মুখে।
কাজ শুরু হতে-না-হতেই পরিকল্পনাটি হোঁচট খেলো। দু-একটা ছোটখাটো অপারেশন তখন হয়ে গেছে। ২৩ জুলাই ঘটল প্রথম অঘটনটি। জায়নিস্ট নেটওয়ার্কের সদস্য ফিলিপ নাতালসন আলেক্সান্দ্রিয়ার একটি সিনেমা হলে ঢুকছিল বোমা নিয়ে। কিন্তু হলের প্রবেশমুখেই কিভাবে যেন বোমাটি তার পকেটেই ফেটে গেল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল নাতালসন। কয়েক দিনের মধ্যে চক্রের বাকি সদস্যরাও আটকা পড়ল পুলিশের জালে।
ধরা পড়াদের মধ্যে এলি কোহেনও ছিল। পুলিশ তার অ্যাপার্টমেন্টে অপারেশন চালাল, কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত করার মতো কোনো প্রমাণ খুঁজে পেল না তারা। ফলে সহজেই ছাড়া পেয়ে গেল সে। কিন্তু মিসরের পুলিশ বিভাগে তার নামে একটি ফাইল খোলা হয়ে গেল। ফাইলে তার তিনটি ছবি লাগল। লেখা হলো নাম : এলি শাউল জান্দি কোহেন। জন্ম : আলেক্সান্দ্রিয়া, ১৯২৪। পিতা-মাতা : শাউল কোহেন ও সোফি কোহেন। তারা এলির দুই বোন ও পাঁচ ভাইকে নিয়ে ১৯৪৯ সালে দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে গেছে। এলি ফ্রান্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে এখন কায়রোর ফারুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
মিসরের পুলিশ জানত না যে, এলির পরিবার ইসরাইলে চলে গেছে এবং তেল আবিবের শহরতলি বাথ ইয়ামে স্থায়ী হয়েছে।
এত ধরপাকড়ের পরও এলি ঠিক করল যে সে মিসরেই থেকে যাবে, পালাবে না। তার গ্রেফতারকৃত বন্ধুদের পরিণাম ভেবে সে অবশ্য শঙ্কিত হলো এবং মিসরের জেলখানায় তাদের ওপর সংঘটিত জুলুম-নিপীড়নের প্রতিটি তথ্য সে সংগ্রহ করল।
অক্টোবরে এসে মিসর সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলো যে তারা কয়েকজন ‘ইসরাইলি গুপ্তচর’কে গ্রেফতার করেছে। ৭ ডিসেম্বরে কায়রোয় তাদের বিচার শুরু হলো। এরই মধ্যে ম্যাক্স বেনেথ নামে এক বন্দী আত্মহত্যা করে বসল। সেলের দরজার একটি পুরনো লোহার শিক ভেঙে তা দিয়েই আত্মহনন করে বেনেথ।
বিচার শুরুর পর বন্দীদের কারো কারো মৃত্যুদণ্ড দাবি করল প্রসিকিউশন। বন্দীদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আবেদন জানালেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাপাল নানচিও, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতগণ, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের দুই সদস্য রিচার্ড ক্রসম্যান ও মরিস অরবাখ, মিসরের প্রধান রাব্বি (ইহুদি ধর্মগুরু) এবং এ রকম আরো অনেকে। কিন্তু সব ব্যর্থ হলো। ১৯৫৫ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশেষ সামরিক আদালত বন্দীদের সাজা ঘোষণা করল : দু’জন বেকসুর খালাস, দু’জনের সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, দু’জনের ১৫ বছর করে এবং অপর দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নেটওয়র্কের দুই নেতা ড. মোশে মারজুক ও ইঞ্জিনিয়ার শ্যামুয়েল আজারকে দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। চার দিন পর কায়রো কারাগারের উঠানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এ দিকে এ ঘটনায় ইসরাইলে ধুন্ধুমার লেগে গেল। সরকার পড়ে যায় যায় অবস্থা। সবার প্রশ্ন, এ রকম একটা স্টুপিড ও ক্রিমিনাল অপারেশন চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো, কিন্তু তারা কেউই সুস্পষ্ট উত্তরটি বের করে আনতে পারল না। ল্যাভন ও গিবলি একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে লাগল। অবশেষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ল্যাভন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবসরজীবন থেকে তুলে এনে তার জায়গায় বসানো হলো বেন গুরিয়নকে। কর্নেল গিবলির আর কোনো পদোন্নতি তো হলোই না, বরং ঘটনার অল্প দিন পরই তিনি সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য হলেন।
অন্য দিকে সেরা বন্ধুদের কয়েকজনকে হারিয়ে এবং পুলিশের সন্দেহের নজরে থেকেও এলি ঠিক করল যে সে কায়রোতেই থেকে যাবে। সে তা-ই করল এবং তার গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকল। সুয়েজ খাল নিয়ে যুদ্ধশেষের পর ১৯৫৭ সালে সে ইসরাইল চলে গেল।
এলির পরিবার যেখানে থিতু হয়েছে সেই বাত ইয়াম এলাকার একটি নিরিবিলি, ছায়াচ্ছন্ন রাস্তার নাম ‘কায়রো শহীদ সড়ক’। এলি তার বাবা-মা-ভাই-বোনদের দেখতে এলে এই রাস্তায় একবার ঘুরে যাবেই।
ইসরাইলে এলির প্রথম দিনগুলো খুব সহজ ছিল না। একটি মনমতো কাজ খুঁজে পাওয়ার জন্য তাকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। তবে তার ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। সে আরবি, ফরাসি, ইংরেজি এবং এমনকি হিব্রু ভাষাও অনর্গল বলতে পারত। এই দক্ষতার কারণে তার একটি কাজ জুটে যায়। কাজটি হলো ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ অ্যামানের জন্য বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিন অনুবাদ করে দেয়া। তার অফিস হলো তেল আবিবে; একটি বাণিজ্যিক সংস্থার ছদ্মাবরণে ওখানেই অ্যামানের কাজ চলে। মোটামুটি চলার মতো একটা মাসিক বেতন ধরা হলো তার : ১৭০ ইসরাইলি পাউন্ড (৯৫ মার্কিন ডলার)। কয়েক মাস পর হঠাৎ তার চাকরি চলে গেল।
কিছু দিনের মধ্যেই তার এক বন্ধু, সেও মিসরীয় ইহুদি, এলিকে একটা নতুন চাকরি জুটিয়ে দেয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইন হামাশবিরের অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি। কাজটা একঘেয়ে, কিন্তু বেতন আগের চাকরির চেয়ে বেশি।
এর মধ্যে একদিন এলির ভাই এলো। তার সাথে সুন্দরী, স্মার্ট এক তরুণী। ইরাকি ইহুদি এই মেয়েটি পেশায় নার্স। ইসরাইলের উঠতি বুদ্ধিজীবী স্যামি মাইকেল মেয়েটির ভাই। তার নাম নাদিয়া। দেখা হওয়ার এক মাসের মাথায় এলি ও নাদিয়া বিয়ে করে ফেলল।
একদিন সকালবেলা। এলি তার অফিসে বসে আছে। এমন সময় সেখানে এলেন এক ভদ্রলোক। বললেন, ‘আমার নাম জ্যালমান। ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আমি আপনার কাছে একটি চাকরির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
‘কী ধরনের চাকরি?’
‘খুব ইন্টারেস্টিং। আপনাকে অনেকবার ইউরোপ ভ্রমণে যেতে হবে। হয়তো আমাদের এজেন্ট হিসেবে আরব দেশগুলোতেও যেতে হতে পারে।’
এবার বেঁকে বসে এলি। বলে, ‘আমি সবে বিয়ে করেছি। এ সময় আমি ইউরোপ-আরব কোথাও অত ঘোরাঘুরি করতে পারব না।’
কথাবার্তা ওখানেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ঘটনা শেষ হয় না। নাদিয়া গর্ভবতী হয় এবং তাই তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইন হামাশবিরেও এ সময় কিছু অদলবদল হয়, তাতে বেশ ক’জন কর্মী চাকরি হারায়। এলি তাদের একজন। সে সহসা আরেকটি চাকরি খুঁজে পায় না। এ সময় একদিন তার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কার যেন টোকা পড়ে। কে এলো?
অনাহূত অতিথি আর কেউ নন, সেই জ্যালমান।
কথায় কথায় তিনি এলিকে বললেন, ‘আপনি আমাদের চাকরিটা কেন নিলেন না, বলুন তো! আমরা আপনাকে প্রতি মাসে সাড়ে তিন শ’ পাউন্ড (১৯৫ মার্কিন ডলার) দেবো। আপনাকে ছয় মাস ট্রেইনিং দেয়া হবে। এরপর আপনার ভালো লাগলে চাকরি করবেন, না লাগলে করবেন না। আপনার যেটা খুশি।’
এবার আর ‘না’ বলতে পারল না এলি। এভাবে সে হয়ে গেল সিক্রেট এজেন্ট বা গুপ্তচর।
অ্যামানের প্রবীণ সদস্যদের কেউ কেউ অবশ্য এ গল্পের একটি ভিন্ন ভার্সন বলেছেন। তারা জানান, ইসরাইলে এসেও এলি অ্যামানে যোগ দিতে পারেনি। কারণ, চাকরির ইন্টারভিউতে সাইকোলজিক্যাল টেস্টে দেখা যায়, এলি ওভারকনফিডেন্ট (অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী)। এমনিতে সে ছিল অনেক সহজাত গুণের অধিকারী, সাহসী এবং তার স্মৃতিশক্তিও চমৎকার। কিন্তু ‘দোষ’ ওই একটাইÑ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী এবং এর প্রভাবে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিয়ে ফেলে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অ্যামানে চাকরির অনুপযুক্ত বিবেচিত হয় এলি।
‘কী ধরনের চাকরি?’
‘খুব ইন্টারেস্টিং। আপনাকে অনেকবার ইউরোপ ভ্রমণে যেতে হবে। হয়তো আমাদের এজেন্ট হিসেবে আরব দেশগুলোতেও যেতে হতে পারে।’
এবার বেঁকে বসে এলি। বলে, ‘আমি সবে বিয়ে করেছি। এ সময় আমি ইউরোপ-আরব কোথাও অত ঘোরাঘুরি করতে পারব না।’
কথাবার্তা ওখানেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ঘটনা শেষ হয় না। নাদিয়া গর্ভবতী হয় এবং তাই তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইন হামাশবিরেও এ সময় কিছু অদলবদল হয়, তাতে বেশ ক’জন কর্মী চাকরি হারায়। এলি তাদের একজন। সে সহসা আরেকটি চাকরি খুঁজে পায় না। এ সময় একদিন তার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কার যেন টোকা পড়ে। কে এলো?
অনাহূত অতিথি আর কেউ নন, সেই জ্যালমান।
কথায় কথায় তিনি এলিকে বললেন, ‘আপনি আমাদের চাকরিটা কেন নিলেন না, বলুন তো! আমরা আপনাকে প্রতি মাসে সাড়ে তিন শ’ পাউন্ড (১৯৫ মার্কিন ডলার) দেবো। আপনাকে ছয় মাস ট্রেইনিং দেয়া হবে। এরপর আপনার ভালো লাগলে চাকরি করবেন, না লাগলে করবেন না। আপনার যেটা খুশি।’
এবার আর ‘না’ বলতে পারল না এলি। এভাবে সে হয়ে গেল সিক্রেট এজেন্ট বা গুপ্তচর।
অ্যামানের প্রবীণ সদস্যদের কেউ কেউ অবশ্য এ গল্পের একটি ভিন্ন ভার্সন বলেছেন। তারা জানান, ইসরাইলে এসেও এলি অ্যামানে যোগ দিতে পারেনি। কারণ, চাকরির ইন্টারভিউতে সাইকোলজিক্যাল টেস্টে দেখা যায়, এলি ওভারকনফিডেন্ট (অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী)। এমনিতে সে ছিল অনেক সহজাত গুণের অধিকারী, সাহসী এবং তার স্মৃতিশক্তিও চমৎকার। কিন্তু ‘দোষ’ ওই একটাইÑ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী এবং এর প্রভাবে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিয়ে ফেলে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অ্যামানে চাকরির অনুপযুক্ত বিবেচিত হয় এলি।
এ সবই পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকের কথা। ষাটের দশকের শুরুতে পরিস্থিতি বদলে যায়। এ সময় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অভিযান চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন এজেন্ট খুঁজছিল অ্যামানের ইউনিট-১৩১। কারণ, কয়েক বছর থেকেই সিরিয়া হয়ে উঠছিল সবচেয়ে আগ্রাসী আরব দেশ এবং ইসরাইলের চরম শত্রু। তারা আক্রমণের কোনো সুযোগই মিস করত না। গোলান উপত্যকা ও গ্যালিলি হ্রদের দখল নিয়ে সিরিয়ার সাথে ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। তারা সুযোগ পেলেই সন্ত্রাসবাদীদের পাঠিয়ে দিত ইসরাইলে। এখন তারা পরিকল্পনা নিচ্ছে, যাতে জর্দান নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ইসরাইলে পানির সঙ্কট দেখা দেবে।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ইসরাইল একটি প্রকল্প নেয়। এ প্রকল্পের অধীনে তারা জর্দান নদীর যে অংশটি ইসরাইলের ভেতর দিয়ে গেছে তাতে অসংখ্য পাইপলাইন বসিয়ে এবং ছোট ছোট খাল খনন করে অনুর্বর নেগেভ অঞ্চলে পানি নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরব নেতারা কয়েকবার শীর্ষ বৈঠকে বসেন। তারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন যে, জর্দান নদীর গতিপথ বদলে ফেলে ইসরাইলি প্রকল্পটিকে মাঠে মেরে দেয়া হবে। দায়িত্বটি চাপে সিরিয়ার কাঁধে।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ইসরাইল একটি প্রকল্প নেয়। এ প্রকল্পের অধীনে তারা জর্দান নদীর যে অংশটি ইসরাইলের ভেতর দিয়ে গেছে তাতে অসংখ্য পাইপলাইন বসিয়ে এবং ছোট ছোট খাল খনন করে অনুর্বর নেগেভ অঞ্চলে পানি নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরব নেতারা কয়েকবার শীর্ষ বৈঠকে বসেন। তারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন যে, জর্দান নদীর গতিপথ বদলে ফেলে ইসরাইলি প্রকল্পটিকে মাঠে মেরে দেয়া হবে। দায়িত্বটি চাপে সিরিয়ার কাঁধে।
কিন্তু জর্দান নদীর পানি ছাড়া তো ইসরাইল বাঁচতে পারবে না, তাই সিরিয়াকে সফল হতে দেয়া যাবে না। অতএব, তারাও পাল্টা পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। এ পরিকল্পনার জন্য দামেস্কে থাকা চাই একজন এজেন্ট, যে হবে বিশ্বাসযোগ্য, আত্মবিশ্বাসী ও দুঃসাহসী। যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য অ্যামান একদা এলিকে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিল, একই বৈশিষ্ট্যের কারণে এখন ইউনিট-১৩১ তাকে যোগ্য ব্যক্তি মনে করছে। (৫০ বছর পর এসে জানা যায়, অ্যামান এই কাজের জন্য আরো কয়েকজনকে নিয়োগ করতে চেয়েছিল। তাদের একজন হচ্ছেন এলির স্ত্রী নাদিয়ার ভাই স্যামি মিশায়েল। তিনি অ্যামানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তিনি ইসরাইলের অন্যতম সেরা কবি হন)।
দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ট্রেইনিং শেষে একদিন জ্যালমান এলেন। সাথে এক তরুণী। তার নাম মারসেলে কাজিন। তরুণীকে তিনি এলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এবার হবে চূড়ান্ত পরীক্ষা, এলি। মারসেলে তোমাকে একটি ফরাসি পাসপোর্ট দেবে। পাসপোর্টটি হবে একজন মিসরীয় ইহুদির নামে, যে কিনা আফ্রিকা চলে গেছে তবে ট্যুরিস্ট হিসেবে ইসরাইল এসেছে। এই পাসপোর্ট নিয়ে তুমি জেরুসালেম যাবে। সেখানে থাকবে ১০ দিন। মারসেলি তোমার কভারের (ছদ্মপরিচয়) বিস্তারিত জানিয়ে দেবে। মনে রেখো, তুমি কিন্তু মিসরের। এখন তুমি পরিবার নিয়ে থাকো আফ্রিকায়। তোমার কাজকর্ম সব সেখানে। আর শোনো, জেরুসালেম থাকার সময় তুমি কথা বলবে কেবল ফরাসি ও আরবি ভাষায়। এ সময় তুমি যত পারো লোকজনের সাথে মিশবে, তাদের বন্ধু বানিয়ে ফেলবে, নতুন নতুন সম্পর্ক গড়বে। তবে কখনোই নিজের আসল পরিচয়টা প্রকাশ করবে না। আর তোমাকে যে-কাজটি অতি অবশ্যই করতে হবে তা হলো তোমাকে কেউ অনুসরণ করছে কি না, সে দিকে কড়া নজর রাখা।
জেরুসালেমে ১০ দিন কাটাল এলি। ফেরার পর তাকে কয়েক দিন ছুটিও দেয়া হলো। ইতোমধ্যে স্ত্রী নাদিয়ার কোলজুড়ে এসেছে এক ফুটফুটে কন্যা। তার নাম রাখা হলো সোফি। ‘রোশ হাসানা’র (ইহুদি নববর্ষ) পর দু’জন অপরিচিত লোককে নিয়ে এলেন জ্যালমান। তিনি তাদের সাথে এলিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কিন্তু লোক দুটো কারা তা বললেন না। তাদের একজন মৃদু হেসে এলিকে বলল, ‘জেরুসালেমের পরীক্ষায় তুমি পাস করেছ, এলি! এবার তোমাকে আরো বড় কাজের ভার নিতে হবে।’
এলি এখন বসে আছে অ্যামান দফতরের একটি খোলামেলা রুমে। তার সামনে একজন আরব শেখ। তিনি খুব ধৈর্যের সাথে এলিকে কুরআন ও নামাজ শেখাচ্ছেন। এলি মন দিয়ে শেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু বারবারই ভুল হয়ে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য ধৈর্য হারাচ্ছেন না তার প্রশিক্ষক। তিনি এলিকে বলেন, ‘চিন্তা কোরো না। কেউ কোনো ধর্মীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে বলবে যে তুমি ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কিছু জানো না। স্কুলে অল্পস্বল্প যা শিখেছ, ওটুকুই।’
এবার এলিকে তার ভবিষ্যৎ মিশনের আগাম কিছু ধারণা দেয়া শুরু হলো : শিগগিরই তাকে কোনো একটি নিরপেক্ষ দেশে পাঠানো হবে। এরপর আরো ট্রেইনিং দিয়ে পাঠানো হবে কোনো আরব দেশের রাজধানীতে।
‘কোথায় সেটা?’ জানতে চায় এলি।
‘সময় হলে বলা হবে।’ বলেন জ্যালমান, ‘সেখানে তুমি হবে একজন আরব। স্থানীয় লোকজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করবে এবং ইসরাইলের একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে।’
এলি কোনো দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে গেল। তার বুকে আত্মবিশ্বাস, পারবই!
তাকে বলা হলো, ‘তুমি সিরিয়ান বা ইরাকি হিসেবে কাগজপত্র পাবে।’
‘কেন? আমি ওসব দেশ সম্বন্ধে কিছুই জানি না। আমাকে বরং মিসরীয় হিসেবে কাগজপত্র দিন।’
‘সেটা অসম্ভব!’ বলেন জ্যালমান, মিসরীয়রা তাদের নাগরিকদের সম্বন্ধে এবং যেসব পাসপোর্ট তার ইস্যু করেছে সবগুলোর হালনাগাদ তথ্য রাখে। এটা খুবই বিপজ্জনক। ইরাক ও সিরিয়া এরকম কোনো রেকর্ড রাখে না। কাজেই তারা তোমাকে খুঁজে পাবে না।’
দুই দিন পর জ্যালমান ও তার সহকর্মীরা এলিকে তার নতুন পরিচয় জানিয়ে গেলেন, ‘তোমার নাম হচ্ছে কামাল। বাবার নাম আমিন তাবেত। অতএব তোমার পুরো নাম হচ্ছে কামাল আমিন তাবেত।’
এলির কেস অফিসাররা তাদের নতুন এই এজেন্টের ছদ্মপরিচয়ের বিস্তারিত তৈরি করে এনেছিলেন। সেটাই তাকে শোনালেন তারা : ‘তুমি হচ্ছ সিরিয়ান মা-বাবার ছেলে। তোমার মায়ের নাম সাঈদা ইব্রাহিম। তোমার এক বোন আছে। তোমার জন্ম হয়েছে লেবাননের বৈরুতে। তোমার বয়স যখন তিন বছর, তখন তোমাদের পরিবার লেবানন ছেড়ে মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় চলে যায়। ভুলে যেয়ো না, মিসরে থাকলেও তোমরা কিন্তু সিরিয়ান। এক বছর পর তোমার বোনটি মারা যায়। তোমার বাবা একজন টেক্সটাইল ব্যবসায়ী। ১৯৪৭ সালে তোমার চাচা আর্জেন্টিনা চলে গিয়েছিল। যাওয়ার অল্প দিন পরেই তিনি তার সাথে থাকার জন্য বুয়েন্স আয়ারসে চলে আসার আমন্ত্রণ জানান তোমাদের পরিবারকে। পরের বছর তোমরা সবাই আর্জেন্টিনা চলে যাও। তোমার বাবা ও চাচা আরো একজনের সাথে পার্টনারশিপে একটি কাপড়ের দোকান দেন। কিন্তু ব্যবসা ভালো চলেনি, দোকানটি লাটে ওঠে। ১৯৫৬ সালে তোমার বাবা মারা যান, এর ছয় মাস পরে তোমার মা-ও। তুমি তোমার চাচার সাথে থাকতে থাকো এবং কাজ জুটিয়ে নাও একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। পরে তুমি ব্যবসা করতে শুরু করো এবং খুব ভালো করো।’
এবার এলির দরকার হয় নিজ পরিবারকে বলার জন্য কিছু বানানো কথার। সে ঘরে ফিরে স্ত্রী নাদিয়াকে বলে, ‘আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি। ওই কোম্পানির কাজ হলো প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে। তাদের একজন লোক দরকার, যে ইউরোপ থেকে ইসরাইলি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনবে এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার খুঁজবে। এ কাজে আমাকে দীর্ঘ সময় বাইরে থাকতে হবে। অবশ্য লম্বা ছুটি নিয়েও আসব। আমি জানি, এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের দু’জনের জন্যই খুব কষ্টদায়ক হবে। এখানে আমার পুরো বেতনটা তোমার হাতে দেয়া হবে। শোনো, ক’টা তো মাত্র বছর। আমরা এর পরেই ইউরোপে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে সেখানেই স্থায়ী হব।’
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে একটি নম্বরবিহীন গাড়ি এলিকে পৌঁছে দিলো লড এয়ারপোর্টে। এক তরুণ, নিজের পরিচয় দিলো কেবল গিডিওন বলে, এলির হাতে তার (এলি) নিজের নামের একটি ইসরাইলি পাসপোর্ট, পাঁচ শ’ আমেকিরান ডলার এবং জুরিখ যাওয়ার একটি বিমান টিকিট তুলে দিলো।
জুরিখ পৌঁছেই এলি দেখা পেল এক ভদ্রলোকের। তার মাথায় ধবধবে সাদা চুল। তিনি এলির পাসপোর্টটি নিয়ে নিলেন এবং তাকে দিলেন অন্য নামে একটি ইউরোপীয় দেশের আরেকটি পাসপোর্ট। পাসপোর্টে লাগানো আছে চিলির এন্ট্রি ভিসা এবং আর্জেন্টিনার ট্রানজিট ভিসা। সাদা চুলের ভদ্রলোক এলির হাতে একটি বিমানটিকেট তুলে দিলেন। টিকিটটি সান্তিয়াগো যাওয়ার। তবে বুয়েন্স আয়ারসে যাত্রাবিরতি থাকবে। ভদ্রলোক এলিকে বললেন, ‘কাল তুমি বুয়েন্স আয়ারস পৌঁছাবে। পরশু বেলা ১১টায় ক্যাফে কোরিয়েন্তেসে থেকো। আমাদের লোক যাবে।’
এলি আর্জেন্টিনার রাজধানীতে একটি হোটেলে উঠল। পরদিন ঘড়ির কাঁটা বেলা ১১টার ঘর ছুঁতে-না-ছুঁতেই ক্যাফে কেরিয়েন্তেসে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল একটু বেশি বয়সী এক লোক। লোকটি নিজের পরিচয় দিলো আব্রাহাম বলে। এলিকে জানাল তার জন্য একটি সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট ইতোমধ্যেই ভাড়া নিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানেই থাকতে হবে তাকে। একজন শিক্ষক প্রতিদিন গিয়ে তাকে স্পেনিশ ভাষা শেখাবেন। আব্রাহাম অভয় দিলেন এলিকে, ‘কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার খরচাপাতির বিষয়টা আমি দেখব।’
তিন মাস পর। পরবর্তীপর্যায়ের জন্য এলি এখন প্রস্তুত। সে এখন চলনসই স্পেনিশ বলতে পারে। বুয়েন্স আয়ারস শহরটা ভালোমতো চিনে নিয়েছে। পোশাক-আশাকে, চালচলনে সে এখন শহরটিতে বসবাসরত কয়েক হাজার আরব অভিবাসীর একজন হয়ে গেছে। এ দিকে তার জন্য আরো একজন টিউটর রাখা হয়েছে। তিনি এলিকে সিরীয় উচ্চারণের আরবি শেখান।
একদিন এক ক্যাফেতে আব্রাহামের সাথে আবার দেখা। আব্রাহাম এবার এলিকে দিলেন একটি সিরিয়ান পাসপোর্ট; কামাল আমিন তাবেতের নামে। বললেন, ‘সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ঠিকানা বদলাতে হবে। নতুন নামে ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলো। আর অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্ট, কালচারাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ক্লাবগুলোতে যেতে থাকো। যেসব সিনেমা হলে আরবি সিনেমা দেখায়, সেখানেও যেয়ো। যত পারো বন্ধু বানাও। আর আরব কমিউনিটি লিডারদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করো। মনে রেখো, তুমি বিত্তশালী মানুষ, একজন মার্চেন্ট এবং একজন ব্রিলিয়ান্ট বিজনেসম্যান। তোমার ব্যবসা হচ্ছে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট। পাশাপাশি তুমি ট্রান্সপোর্ট এবং ইনভেস্টমেন্টেও জড়িত। কাজেই, আরব কমিউনিটির দাতব্য তহবিলগুলোতে দরাজ হাতে দান করতে ভুল কোরো না। গুড লাক!’
ইসরাইলি গুপ্তচরটির জীবনে গুড লাকের প্রাচুর্য এলো যেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বুয়েন্স আয়ারসের আরব-সিরিয়ান কমিউনিটির একেবারে মধ্যমণি হয়ে গেল এলি কোহেন। তার ব্যক্তিগত আকর্ষণ, আত্মবিশ্বাস, কমন সেন্স এবং সম্পদ আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী আরবদের অনেককে কাছে টানল। দেশটির আরব বলয়ে সে হয়ে উঠল গণ্যমান্য একজন। মুসলিম ক্লাবে এক সন্ধ্যায় আরো একটি সাফল্য এলো তার গুপ্তচরজীবনে। সেদিন তার সাথে সাক্ষাৎ হলো সুবেশী, সুদর্শন, টেকোমাথা, ঝাঁকড়া গোঁফঅলা এক অভিজাত মানুষের। মানুষটি নিজের পরিচয় দিলেন আবদেল লতিফ হাসান, আর্জেন্টিনার আরব ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক বলে। ‘সিরিয়ান অভিবাসী’ মানুষটির প্রখর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন হাসানও। সে দিনই দু’জন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলেন।
মুসলিম ক্লাবে প্রায়ই নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠান শেষে আরব কমিউনিটির নেতাদের আড্ডা বসত। এলি গেস্টদের তালিকায় সিরিয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নাম ঢুকিয়ে দিলো। এরপর নানা রকম পশ পার্টি ও রিসেপশনে তারাও আমন্ত্রিত হতে লাগলেন। একবার সিরিয়ান দূতাবাসের এক অফিসিয়াল রিসেপশনে হাসান তার বন্ধু তাবেতকে টেনে নিয়ে গেলেন জবরদস্ত চেহারার এক অফিসারের দিকে; তার গায়ে সিরিয়ান জেনারেলের পোশাক। হাসান জেনারেলকে কেতাদুরস্ত ভাষায় বললেন, ‘একজন খাঁটি ও ত্যাগী সিরিয়ান দেশপ্রেমিক মানুষকে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে অনুমতি দিন’ এবং এরপরই এলির দিকে ঘুরলেন : ‘জেনারেল আমিন-এল-হাফেজের সাথে পরিচিত হোন। উনি সিরিয়ান অ্যাম্বাসির মিলিটারি অ্যাটাশে।’
এলির মনে হলো নিজের সাফল্যের পথে চূড়ান্তপর্যায়টি অতিক্রম করে ফেলেছে। এবার সময় এসেছে সত্যিকার মিশনে নামার। ১৯৬১ সালের জুলাইয়ে আব্রাহামের সাথে তার এক গোপন সংক্ষিপ্ত বৈঠক হলো। আব্রাহাম তাকে তার পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে ব্রিফ করলেন। পরদিন এলি গেল হাসানের অফিসে। ধরা গলায় বলল, ‘আর্জেন্টিনা থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’ জানাল সে যেকোনো কিছুর চেয়ে সিরিয়াকেই বেশি ভালোবাসে এবং এখন সিরিয়ায় ফিরে যেতে চায়। হাসান কি তাকে কয়েকটি প্রত্যয়নপত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারে? সম্পাদক হাসান এক কথায় রাজি। তিনি তৎক্ষণাৎ চারটি চিঠি লিখলেন : একটি আলেক্সান্দ্রিয়ায় তার শ্যালকের কাছে, বৈরুতে দুই বন্ধুর কাছে (এদের একজন প্রভাবশালী ব্যাংকার) এবং চতুর্থটি দামেস্কে নিজের ছেলের কাছে। এরপর এলি একে একে গেল তার অন্য আরব বন্ধুদের কাছে। অচিরেই তার ব্রিফকেসটি উৎসাহপূর্ণ প্রত্যয়নপত্রে পূর্ণ হয়ে গেল। বুয়েন্স আয়ারসের আরব কমিউনিটির নেতারাই চিঠিগুলো লিখেছেন।
১৯৬১ সালের জুলাই মাসে কামাল আমিন তাবেত প্রথমে বিমানে করে জুরিখ গেল। তারপর সেখান থেকে বিমান বদল করে উড়ে গেল মিউনিখের দিকে। জার্মান রাজধানীর বিমানবন্দরে একজন ইসরাইলি এজেন্ট দেখা করল তার সাথে। তার নাম জেলিংগার। সে এলিকে তার ইসরাইলি পাসপোর্ট এবং তেল আবিব যাওয়ার বিমান টিকেট দিলো। আগস্টের গোড়ার দিকে ঘরে ফিরল এলি। স্ত্রী নাদিয়াকে বলল, ‘আগামী কয়েক মাস আমি তোমার সাথে কাটাব।’
পরের মাসগুলো কাটতে লাগল নিবিড় ট্রেইনিংয়ের ভেতর দিয়ে। এলির ছদ্মবেশ ছিল নিখুঁত। সে তার নতুন পরিচয়ের সাথে সম্পূর্ণরূপে মিশে গেল। ইয়েহুদা নামে এক রেডিও ইন্সট্রাক্টর তাকে শিখিয়ে দিলেন কিভাবে সাঙ্কেতিক ভাষায় রেডিও ট্রান্সমিশন করতে হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এলি মিনিটে ১২ থেকে ১৬টি শব্দ প্রেরণ ও গ্রহণ করতে শিখে গেল। এ ছাড়া তাকে সিরিয়া নামের দেশটি, এর সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশল সম্বন্ধে অনেক বইপত্র ও দলিলপত্র পড়তে হলো। এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অসংখ্য ব্রিফিং নিতে হলো তাকে। সব মিলিয়ে এলি সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিবিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞে পরিণত হলো।
১৯৬১ সালে এলি আবার জুরিখে গেল। তবে তার চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল দামেস্ক অর্থাৎ সিংহের গুহায়। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তখন খুবই খারাপ। শাসকগোষ্ঠী যতই দুর্বল হচ্ছিল, সিরিয়া-ইসরাইল সীমান্তে উত্তেজনা ততই বাড়ছিল। ১৯৪৮ সালের পর থকে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান দেশটিকে সুস্থির থাকতে দিচ্ছিল না। কোনো সিরিয়ান একনায়কের স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল এক বিরল ঘটনা। তাদের মৃত্যু হতো ফাঁসিতে, নয়তো বা ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা গুপ্তঘাতকের হাতে। মোটের ওপর, অস্থিতিশীল দেশটিতে একটা-না-একটা গোলযোগ লেগেই থাকে। এসব অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে রাখতে সিরিয়ান নেতারা সীমান্তে লাগামহীনভাবে কিছু একটা ঘটনা ঘটিয়ে থাকত। অন্যদিকে প্রায় প্রতিদিনই কাউকে-না-কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হতোই। তাদের গায়ে সাঁটানো হতো ‘চক্রান্তকারী, গুপ্তচর, দেশদ্রোহী অথবা সাবেক সরকারে সমর্থক’ লেবেল। এলি সিরিয়ার পৌঁছার অল্প কিছু দিন আগেই, ১৯৬১ সালেল ২৮ সেপ্টেম্বর, একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। নতুন শাসকরা এসেই স্বল্পস্থায়ী মিসর-সিরিয়া ইউনিয়ন, যার নাম ছিল সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, বাতিল করে দেয়।
মিশনে যাওয়ার আগে এলির সাথে আবার সাক্ষাৎ হলো সেই সর্বত্রগামী ব্যক্তির জ্যালমান। তিনিই এলিকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিলেন : মিউনিখে আমাদের লোক জেলিন্দার আছে। তুমি তার কাছ থেকেই রেডিও ট্রান্সমিটার পাবে। দামেস্ক আসার পর সিরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের একজন কর্মী তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। সেও তোমার মতোই একজন ‘ইমিগ্র্যান্ট’। তবে সে সিরিয়া এসেছে বেশি দিন হয়নি। সে তোমার আসল পরিচয় জানে না। তাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। সময় হলে সে-ই তোমার সাথে যোগাযোগ করবে।
এলি মিউনিখ পৌঁছাতেই জেলিঙ্গার তার জন্য স্পাইং ইকুইপমেন্টের একটি আকর্ষণীয় প্যাকেজ নিয়ে হাজির। তাতে আছে অনেকগুলো সাদা কাগজ। সেই কাগজে অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা আছে ট্রান্সমিশন কোড। আছে বেশ কিছু বই, যা ট্রান্সমিশন কোড হিসেবে কাজ করে। একটি বিশেষ ধরনের টাইপরাইটারও আছে। আছে একটি ট্রানজিস্টার রেডিও, যাতে লাগানো আছে ট্রান্সমিটার। আরো আছে একটি ইলেকট্রিক রেজর, যার তারগুলো ট্রান্সমিটারের অ্যান্টেনা হিসেবে কাজ করে। ইয়ার্ডলে সাবান ও সিগারেটের ভেতর লুকানো আছে ডিনামাইট স্টিক এবং কিছু সায়ানাইড পিল। যদি কখনো প্রয়োজন হয়ে পড়ে...
এলি ভেবে পেল না, এত জিনিসপত্র সে কিভাবে সিরিয়ায় নিয়ে যাবে। ওদের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন তো ভয়ঙ্কর; সব কিছু তন্ন তন্ন করে দেখে।
এ প্রশ্নের উত্তরও জেলিঙ্গারের কাছে ছিল। তিনি বললেন, ‘তুমি এসএস অ্যাস্টোরিয়ার একটি প্যাকেজ কিনবে। জানুয়ারির গোড়ার দিকে ওটি জেনোয়া থেকে বৈরুত যাবে। ওই নৌকায় কেউ একজন থাকবে। সে-ই জিনিসপত্রগুলো সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কাজে তোমাকে সাহায্য করবে।’
অ্যাস্টোরিয়ায় চেপে বসল এলি। একদিন সকালে সে একদল মিসরীয় যাত্রীর কাছাকাছি বসেছিল। এ সময় একজন তার দিকে এগিয়ে এলো এবং ফিসফিস করে বলল, ‘এসো।’ এলি উঠে দাঁড়াল এবং লোকটির পেছন পেছন গেল। লোকটি বলল, ‘আমার নাম মাজেদ শেখ এল-আরদ। আমি একটি গাড়ি এনেছি।’ এলি বুঝল, এই লোকই তাকে দামেস্ক পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
এল-আরদ লোকটি বেঁটেখাটো। কেমন ভীরু টাইপ চেহারা। তবে একেবারে সাধারণ লোক নয়; দামেস্কের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। বিয়ে করেছে মিসরের এক ইহুদি কন্যাকে। তার অস্থির ও লোভী চরিত্রই তাকে এজেন্ট বানাতে প্রলুব্ধ করেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা বিভাগকে। তবে তাকে যে ইসরাইলিরা এজেন্ট বানিয়ে ফেলেছে এ বিষয়টাই বুঝতে পারেনি লোকটা। তার ধারণা, সে সিরিয়ার কট্টর ডানপন্থীদের হয়ে কাজ করছে, যারা কিনা গোপনে তৎপরতা চালায়। কামাল আমিন তাবেত সম্পর্কিত বানোয়াট গল্পগুলোও সে অবলীলায় বিশ্বাস করে এবং পরবর্তী সময়ে এই ইসরাইলি গুপ্তচরটির বড় সহায়কে পরিণত হয়।
তবে তার প্রথম কাজটি ছিল তাবেতের ব্যাগেজগুলো নিরাপদে সিরিয়া ভূখণ্ডে পৌঁছে দেয়া।
১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি। বৈরুত থেকে আসা এল-আরদের গাড়িটিকে সীমান্তে থামানো হলো। এলি বসেছিল যাত্রীর আসনে, এল-আরদের পাশে। তার ব্যাগভর্তি গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জাম।
গাড়ি থামানোর পর এল-আরদ বলল, ‘আমরা আমার বন্ধু আবু খালদুনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। সে টাকা-পয়সার একটু টানাটানিতে আছে। পাঁচ শ’ ডলার পেলে তার একটু উপকার হয়।’
মুহূর্তের মধ্যে ইসরাইলি গুপ্তচরের ওয়ালেট থেকে পাঁচ শ’ ডলার বেরিয়ে সিরিয়ান কাস্টমস ইন্সপেক্টর আবু খালদুনের পকেটে ঢুকে পড়ল। আর গাড়ি ছুটে চলল মরুভূমির মাঝ দিয়ে।
এলি কোহেন এখন সিরিয়ায়।
গাড়ি থামানোর পর এল-আরদ বলল, ‘আমরা আমার বন্ধু আবু খালদুনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। সে টাকা-পয়সার একটু টানাটানিতে আছে। পাঁচ শ’ ডলার পেলে তার একটু উপকার হয়।’
মুহূর্তের মধ্যে ইসরাইলি গুপ্তচরের ওয়ালেট থেকে পাঁচ শ’ ডলার বেরিয়ে সিরিয়ান কাস্টমস ইন্সপেক্টর আবু খালদুনের পকেটে ঢুকে পড়ল। আর গাড়ি ছুটে চলল মরুভূমির মাঝ দিয়ে।
এলি কোহেন এখন সিরিয়ায়।
দামেস্ক প্রবল ভিড় ও কোলাহলমুখর এক মহানগরী। এর সবখানে জনাকীর্ণ মসজিদ ও বর্ণাঢ্য আরবীয় বাজার। কাজেই যে-কারো পক্ষে এই ভিড়ে মিশে যাওয়া মোটেই কঠিন কিছু নয়। এলি কিন্তু তা চাচ্ছে না, তার চাওয়া বরং উল্টো। সে চাচ্ছে মানুষের চোখে পড়তে; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
এলি অভিজাত আবু রামেন এলাকায় একটি বিলাসবহুল ভিলা ভাড়া নিলো। ভিলাটি সিরিয়ান সেনা সদর দফতরের পাশ ঘেঁষে। নিজের ভিলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এলি দেখতে পায় সরকারি অতিথিশালার সদর দরজাও। বিদেশী দূতাবাস, ধণাঢ্য ব্যবসায়ীদের আবাস এবং জাতীয় নেতাদের সরকারি বাসভবনের চৌহদ্দির মধ্যেই তার বাড়িটির অবস্থান। সে অবিলম্বে বাড়ির বিভিন্ন গোপন জায়গায় গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জামগুলো বসিয়ে ফেলে। বাড়ির গোপন খবর পাচার হবে এই ভয়ে সে কোনো কাজের মানুষ রাখবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেয় এবং একাই থাকতে থাকে।
এলি আসলেই ভাগ্যবান। ভাগ্য এবারও তাকে সহায়তা দেয়। সে দামেস্ক আসে একেবারে ‘ঠিক সময়’টিতেই। সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র বাতিল করে দেয়াটাকে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের ভালোভাবে নেননি। তিনি একে তার নিজের ও দেশের জন্য অপমান হিসেবে নেন। ফলে সিরিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় দিকের নেতাদের মধ্যে একটা ভয় দানা বেঁধে ওঠে যে, মিসরের মদদপুষ্ট আরেকটি অভ্যুত্থান বুঝি আসন্ন। এ ভীতিতে তারা এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে, ইসরাইলের কথা তাদের ভাবনাতেই আসেনি। তাই তাদের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল নতুন মিত্র, সমর্থক ও দেশের ভেতরে-বাইরে অর্থের উৎস। কট্টর জাতীয়তাবাদী কোটিপতি কামাল আমিন তাবেত ছিলেন এই ‘ঠিক সময়ের ঠিক মানুষটি।’
এলি কোহেন এবার মাঠে নেমে পড়ল। বিভিন্ন মহলের সাথে দ্রুত যোগাযোগ তৈরি করে ফেলল সে। এ ক্ষেত্রে সেই প্রত্যয়নপত্রগুলো খুব কাজে লাগল। প্রত্যয়নপত্রের চাবি দ্রুত খুলে ফেলল অভিজাত সোসাইটি, ব্যাংক এবং বাণিজ্যবলয়ের তালা। নতুন বন্ধুরা তাকে পরিচয় করিয়ে দিলো সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, সিনিয়র আর্মি অফিসার এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে। দু’জন ধনী ব্যবসায়ী তো এই তরুণ ও সুদর্শন কোটিপতির (এলি) সাথে একরকম সেঁটেই রইলেন এই আশায় যে, সে তাদের একজনের মেয়েকে বিয়ে করবে। দামেস্কে তখন দরিদ্র মানুষদের জন্য একটি সরকারি কিচেন তৈরি হচ্ছিল। দাক্ষিণ্য দেখাতে তাতে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করল এলি কোহেন। এতে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ল সরকারি মহল পর্যন্ত। কিন্তু তখন পর্যন্ত সিরিয়ার নতুন শাসকগোষ্ঠীর কাছ ঘেঁষেনি সে। কারণ, সে অনুভব করছিল, এরা সবাই অস্থায়ী। মিসর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটা বড় ধাক্কা সামলাতে হবে সিরিয়াকে। তারপরই সব কিছু মোটামুটি সুস্থির হবে।
এলি দামেস্কে পৌঁছার এক মাস পর তার সাথে দেখা করতে এলো জর্জ সালেম সেইফ। প্রবাসী সিরিয়ানদের জন্য পরিচালিত রেডিও দামেস্কের একটি শোর উপস্থাপক। জ্যালমান তার শেষ ব্রিফিংয়ে এর কথাই এলিকে বলেছিলেন। এলির অল্প কিছু দিন আগে সেইফ সিরিয়ায় ‘ফিরে’ এসেছে। এখন সে যে পদে আছে, তাতে করে রাজনৈতিক ও সামরিক মহলের ভেতরের সব খবর এলিকে জানাতে পারবে সে। সেইফ প্রচার মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইনও এলিকে দেখাল, যাতে বলা আছে কী প্রচার করা যাবে আর কোনটা শ্রোতাদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হবে।
এই সাক্ষাতের পর সেইফের বাড়িতে যত পার্টি হয়েছে, সবগুলোতেই এলি হাজির ছিল এবং সেখানে তার সাক্ষাৎ হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ ক’জন সিনিয়র অফিসার ও সুপরিচিত রাজনীতিবিদের সাথে।
অবশ্য এল-আরদের মতো সেইফও এলির আসল পরিচয় জানত না। তারও ধারণা ছিল যে এলি হচ্ছে একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী, যার নিজস্ব একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে।
একসময় এলি কোহেনের মনে হতে থাকে যে সে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ গুপ্তচর। তার এমনকি একজন বন্ধু বা সহচরও নেই। অবশ্য, এলির জানা ছিল না যে, দামেস্কে ইসরাইলের অন্য একটি নেটওয়ার্কও কাজ করে যাচ্ছে। সে বুঝল, এই ভয়াল নিঃসঙ্গতাকে পাশ কাটাতে তাকে নার্ভ লোহার মতো শক্ত করতে এবং ২৪ ঘণ্টাই কাজে ডুবে থাকতে হবে। সে জানে, এমনকি যখন ছুটিছাটায় বাড়ি যাবে তখনো সে তার প্রিয়তমা পত্নীকে তার কাজের গল্প করতে পারবে না, বরং বানানো গল্পই বলতে হবে।
এলি ইসরাইলে ‘খবর’ পাঠাতে শুরু করল। প্রতিদিন সকাল ৮টায় খবর পাঠায় সে। প্রয়োজন হলে কোনো কোনো দিন সন্ধ্যায়ও পাঠাতে হয়। তার এই কার্যক্রম একটি পূর্ণ নিরাত্তার চাদরে আবৃত। তার ট্রান্সমিটারটি অবস্থিত তার ভিলায়, আর ভিলাটি সেনাসদরের খুব কাছে অবস্থিত। সেনাসদর হচ্ছে অসংখ্য ট্রান্সমিশনের উৎস। কাজেই কোনটি এলির ব্রডকাস্ট আর কোনটি সেনাসদরের কমিউনিকেশন সেন্টার থেকে এসেছে, তা বুঝতেই পারবে না কেউই।
ছয় মাসের মধ্যে কামাল আমিন তাবেত দামেস্কের হাই সোসাইটির একজন হোমরা-চোমরায় পরিণত হয়ে গেল। একদিন সে ‘ব্যবসায়িক কাজে’ বিদেশ যেতে মনস্থ করল। তার প্রথম গন্তব্য আর্জেন্টিনা। সেখানে সে তার আরব বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করল। তারপর ছুটল ইউরোপের দিকে। সেখান থেকে একের পর এক বিমান ও গন্তব্য বদল করে করে সে এসে নামল লড এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে বাত ইয়ামের অ্যাপার্টমেন্টে, যেখানে স্ত্রী নাদিয়া ও কন্যা সোফি তার অপেক্ষায় আছে।
কিছু দিন পর এলি কোহেন চড়ে বসল ইউরোপগামী বিমানে আর কয়েক দিন পর কামাল আমিন তাবেত হয়ে সে পৌঁছাল দামেস্কে। ইসরাইল থাকাকালে অ্যামানের সিনিয়ররা তাকে দিয়েছিল একটি মিনিয়েচার ক্যামেরা, যাতে সে বিভিন্ন স্থান ও দলিলপত্রের ছবি নিয়ে নিতে পারে। মাইক্রোফিল্মগুলো একটি ক্রীড়া সরঞ্জামের বাক্সে লুকিয়ে প্রথম আর্জেন্টিনায় বন্ধুদের কাছে পাঠাল এলি। বন্ধুরা কূটনৈতিক কভারের আড়ালে সেগুলো পাঠিয়ে দিলো সিরিয়ায়।
এলি প্রথম দিকে যেসব খবর পাঠিয়েছিল তাতে ছিল সেনাবাহিনীতে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং বাথ পার্টির ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা। সে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পারছিল যে, সিরিয়ায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন। সে বাথ পার্টির নেতাদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হলো এবং পার্টি ফান্ডে বড় অঙ্কের চাঁদা দিলো।
এলি ঠিক কাজটিই করেছিল। ১৯৬৩ সালের ৮ মার্চ নতুন একটি অভ্যুত্থান হলো। সেনাবাহিনী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করল এবং বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। এলির বুয়েন্স আয়ারসের বন্ধু জেনারেল হাফেজ হলেন সালাহ আল-বিতারের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের প্রতরিক্ষামন্ত্রী। জুলাই মাসে আরো একটি অভ্যুত্থান হলো। তবে এটা শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে। এবার জেনারেল হাফেজ হলেন বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রপ্রধান। তাবেতের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মন্ত্রিসভা ও সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেল। এভাবে একজন ইসরাইলি গুপ্তচর হয়ে গেল সিরিয়ার ক্ষমতাবলয়ের সদস্য।
দামেস্কে একটি ঝলমলে পার্টি। একের পর এক বিলাসবহুল গাড়ি এসে থামছে চমৎকার ভিলাটির সামনে আর সেখান থেকে নামছেন মন্ত্রী ও জেনারেলরা। সুবেশী মেহমানরা ঢুকছেন ভিলায়, মেজবান তাদের জানাচ্ছেন উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা। মেহমানদের মধ্যে আছেন সমাজের শীর্ষব্যক্তিরা। যেমন প্রতিরক্ষা ও কৃষি সংস্কারমন্ত্রী, অনেক জেনারেল ও কর্নেল, বাথ পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও ধণাঢ্য ব্যক্তিরা। মেহমানদের অনেকেই কর্নেল সালিম হাতুমের চার পাশে জড়ো হয়ে আছেন। এই অফিসারই অভ্যুত্থানের রাতে দামেস্কে ট্যাংক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জেনারেল হাফিজকে প্রেসিডেন্ট বানানোর কৃতিত্বও তার।
প্রেসিডেন্ট হাফিজ এলেন বেশ একটু পরে। এসেই তিনি মেজবান ও বন্ধু কামাল আমিন তাবেতের সাথে উষ্ণ করমর্দন করলেন। সাথে ছিলেন মিসেস হাফেজও। তাবেত অবাক হয়ে দেখল, মিসেস হাফিজের গায়ে যে কোটটি সেটি তারই দেয়া উপহার। তবে মিসেস হাফিজ একা নন, আরো অনেক মহিলাকেই তাবেত উপহার দিয়েছিল। তাদের প্রায় সবাই সেসব পরে এসেছেন। অনেক সিনিয়র অফিসারকে দিয়েছিল গাড়ি। আজ তারাও সেই গাড়ি চালিয়ে পার্টিতে এসেছেন। অনেক বড় নেতার অ্যাকাউন্টে তার টাকা ‘জমা’ আছে।
এদিকে লিভিং রুমে বেশ ক’জন কর্মকর্তা এবং আর্মি অফিসার তুমুল আড্ডায় মেতে উঠেছেন। ওই আর্মি অফিসারদের কেউ কেউ ইসরাইল সীমান্ত থেকে ফিরেছেন। তারা সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলেন। আড্ডায় ছিলেন ক’জন উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলীও। জর্দান নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে কাজ করেন এরা। বড়সড় রুমটির এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সরকার নিয়ন্ত্রিত রেডিও দামেস্কের কয়েকজন পরিচালক এবং প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। তাবেত এখন তাদেরই একজন সরকার তাকে বলে দিয়েছে প্রবাসী সিরিয়ানদের জন্য কিছু অনুষ্ঠান করতে। এ ছাড়া তাবেত আরো একটি রেডিও শো চালায়, যেখানে সে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলে।
অন্য অনেকের মতো তাবেতের জন্যও কিছু সৌভাগ্য বয়ে আনে এই পার্টি। কিন্তু সেটা সে বুঝতে দেয় না। এখন অসংখ্য সাফল্য তার হাতের মুঠোয়, যেন সাফল্যের এমন কোনো দরজা নেই, যেটি সে খুলতে পারে না। সেনাসদরে তার অনেক বন্ধুবান্ধব। আর ক্ষমতাসীন বাথ পার্টির নীতিনির্ধারণী সব বৈঠকে সে যোগ দেয়।
এরই মধ্যে এলি নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে থাকে ইসরাইলে। তাতে থাকে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর চরিত্র, সিনিয়র অফিসারদের নামধাম ও দায়িত্ব, অতি গোপনীয় সামরিক আদেশ-নির্দেশ এবং অন্য অনেক বিষয়। মিলিটারি ম্যাপের ছবিও পাঠায় সে, বিশেষ করে ইসরাইল সীমান্তজুড়ে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার ব্লু প্রিন্টগুলোই সে পাঠিয়ে থাকে অ্যামানের কাছে। জানিয়ে দেয় সিরিয়ান সেনাবাহিনী কী কী নতুন অস্ত্র কিনেছে এবং নতুন কোনো অস্ত্র ব্যবহারের কতটা ক্ষমতা তাদের আছে। মোটের ওপর সিরিয়ান সেনাবাহিনীর এমন কোনো গোপন খবর ছিল না, যা এলি জানত না।
এলি প্রতিদিন সকালে সব খবর ইসরাইলকে জানিয়ে দিত। ধরা পড়ার কোনো ভয় তার মনের আনাচে-কানাচেও ছিল না। থাকবে কেন? সে জানে, কাছেই সেনাসদরে আছে সিরিয়ান আর্মি ব্রডকাস্ট। তারা অহরহ বার্তা প্রেরণ ও গ্রহণ করছে। এর মাঝখানে কে ইসরাইলে মেসেজ পাঠাল, বুঝবে কে আর ধরবেই বা কে!
তা ঠিক। তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। একদিন সকালে এলির বন্ধু লেফটেন্যান্ট জাহের আল-দীন কিছু না বলেকয়ে এলির বাসায় এসে হাজির। এলি তখন ইসরাইলে ট্রান্সমিট করছিল। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়েই সে তড়িঘড়ি করে ট্রান্সমিটারটা লুকিয়ে ফেলতে পারল ঠিকই, কিন্তু এক শিট কাগজ পড়ে রইল টেবিলের ওপর কাগজটিতে গ্রিড আঁকা, আর তাতে বিভিন্ন বর্ণ লেখা।
‘এটা কী?’ জানতে চাইলেন লে. জাহের।
‘আরে, ক্রসওয়ার্ড!’ কোনোমতে সামলে নিলো এলি।
ইসরাইলের সাথে যোগাযোগ রাখার আরো একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল এলি। সেটি হলো রেডিও দামেস্ক। তেল আবিবে সিনিয়ানরা তাকে কিছু সাংকেতিক শব্দ ও প্রবাদবাক্য শিখিয়ে দিয়েছিল। এলি তার রেডিও ব্রডকাস্টে কৌশলে এগুলো ব্যবহার করত আর তেল আবিবে বসে অ্যামান ঠিকই এসবের অর্থ বের করে ফেলত।
অতি গোপনীয় তথ্য বের করে আনতে এবার নতুন একটি কৌশল নিলো তাবেত বা এলি। দামেস্কের সরকারি মহলে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, তাবেতের ভিলায় সেক্স পার্টি অনুষ্ঠিত হয়। কেবল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই এসব পার্টিতে আমন্ত্রণ পান। আমন্ত্রিতরা সেখানে অনেক সুন্দরী মহিলার সান্নিধ্য পান। এসব মহিলার অনেকেই পেশাদার পতিতা, আবার কেউ কেউ ভালো পরিবার থেকেও আসা। আমন্ত্রিতরা পার্টিতে উদ্দাম যৌনতায় মেতে ওঠেন, কেবল আমন্ত্রণকর্তাই এসবের বাইরে থেকে যান।
তাবেত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত তার বন্ধুদের সেক্সি ও উদার নারী সেক্রেটারিও জোগান দেয়। এসব বন্ধুর একজন হচ্ছেন কর্নেল সালিম হাতুম। তার রক্ষিতাটি কর্নেলের এমন কোনো গোপন কথা নেই, যা তাবিতকে বলে দেয় না।
ইসরাইলের প্রসঙ্গ উঠলেই তাবিত কট্টর দেশপ্রেমিকের ভূমিকা নেয়। ইসরাইলকে সে ‘আরব জাতীয়তাবাদের জঘন্যতম শত্রু’ ছাড়া কথাই বলে না। সে মিসরের পাশাপাশি ইসরাইলের বিরুদ্ধেও প্রচারণার ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট’ খুলতে নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানায়। এমনকি তার সামরিক বাহিনীর বন্ধুদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করে যে, তারা আগ্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কাজ করছে না।
এলির ঠেলে দেয়া বল এবার গোলপোস্টে ঢোকে। তার সামরিক বাহিনীর বন্ধুরা স্থির করে যে, তারা এলির অভিযোগকে ভুল প্রমাণিত করবে এবং তাকে হাতেনাতে দেখিয়ে দেবে যে, তারা দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
তা-ই হলো। তারা নিজেদের অবস্থান দেখাতে এলিকে তিনবার ইসরাইল সীমান্তে নিয়ে যায়। দেখায় নিরাপত্তা প্রাচীর ও বাংকার, ওখানে মজুদ করা অস্ত্রের ভাণ্ডার এবং জানায় প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ পরিকল্পনার বিস্তারিত। লেফটেন্যান্ট জাহের আলদীন এলিকে নিয়ে গেলেন এল-হামা মিলিটারি ক্যাম্পে, যেখানে রয়েছে নতুন অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল মজুদ।
চতুর্থ যেবার তাবিত সীমান্তে গেল, সেবার গোটা দলে সে-ই ছিল একমাত্র অসামরিক ব্যক্তি। বাকি সবাই সিরিয়া ও মিসরের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। সেবার দলটির নেতৃত্বে ছিলেন আরব সামরিক নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষটি মিসরের জেনারেল আলী আমের। তিনি ছিলেন ইউনাইটেড আরব কমান্ডমেন্টের প্রধান অর্থাৎ কাগজে-কলমে হলেও মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের সম্মিলিত বাহিনীর নেতা।
জেনারেল আমেরের সফরের পরপরই বাথ পার্টির নেতারা তাবেতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। তাকে পাঠানো হয় পার্টির প্রবীণ নেতা সালাহ আল-বিতারের সাথে একটা সমঝোতা করতে। সালাহ আল-বিতারকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জেনারেল হাফিজ। বিতার এখন ‘স্বাস্থ্যরক্ষায়’ জেরিকোয় রয়েছেন। দলের নির্দেশে তাবেত জর্দান গেল এবং ক’টা দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে কাটাল। দেশে ফিরেই বিমানবন্দরে দেখা হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট হাফিজের সাথে। অসুস্থ প্রেসিডেন্ট চিকিৎসার জন্য প্যারিস যাচ্ছেন। কয়েক সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট যখন দেশে ফিরলেন, তখন তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য টারমাকে দাঁড়ানো বিশিষ্টজনদের সারিতেও তাবিতকেও দেখা গেল। তার মিশন শেষ হয়েছে, সফল হয়েছে।
১৯৬৩ সালে ইসরাইলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো। লিটল ইজেরের পরিবর্তে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হলেন মেইর অ্যামিত। কয়েক মাস তিনি অ্যামান ও মোসাদ দুটোরই প্রধান হিসেবে কাজ করলেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন, ইউনিট-১৩১ বিলুপ্ত হবে এবং এর সব অপারেশন ও লোকবল মোসাদের অঙ্গীভূত হবে। এক সকালবেলায় এলি কোহেনও জেনে গেল যে তার বস বদলে গেছে এবং সে এখন মোসাদের এজেন্ট।
একই বছর স্ত্রী নাদিয়া তাকে উপহার দিলো দ্বিতীয় কন্যা আইরিশ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে, এলি তখন ছুটি কাটাচ্ছে ইসরাইলে, তার মনের গোপন একটি স্বপ্ন পূরণ হলো নাদিয়ার কোলজুড়ে এলো তাদের তৃতীয় সন্তান; তবে মেয়ে নয়, ছেলে। নাম রাখা হলো শাউল।
ছেলের পিতা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও পরিবারের লোকজনের চোখ এড়ায় না, এলি এবার কেমন যেন খাপছাড়া, নার্ভাস, বিষণ্ন। মাঝে মধ্যেই তার মেজাজ চড়ে যায়। সে বাইরে বের হতে চায় না, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যায় না। এক দিন সে নাদিয়াকে বলে, ‘এবার আমি এই চাকরিটা ছাড়ব। এরপর ইসরাইলে চলে আসব। তোমাদের ছেড়ে আর দূরে দূরে থাকতে চাই না আমি।’
নভেম্বর শেষ হতে চলল। এবার এলির বিদায়ের পালা। এলি তার স্ত্রী নাদিয়া ও তিন সন্তানকে বিদায়ী চুম্বন দিয়ে বিমান চড়ে বসল। নাদিয়া জানত না যে, এ বিদায়ই এলির শেষ বিদায়।
একই বছর স্ত্রী নাদিয়া তাকে উপহার দিলো দ্বিতীয় কন্যা আইরিশ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে, এলি তখন ছুটি কাটাচ্ছে ইসরাইলে, তার মনের গোপন একটি স্বপ্ন পূরণ হলো নাদিয়ার কোলজুড়ে এলো তাদের তৃতীয় সন্তান; তবে মেয়ে নয়, ছেলে। নাম রাখা হলো শাউল।
ছেলের পিতা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও পরিবারের লোকজনের চোখ এড়ায় না, এলি এবার কেমন যেন খাপছাড়া, নার্ভাস, বিষণ্ন। মাঝে মধ্যেই তার মেজাজ চড়ে যায়। সে বাইরে বের হতে চায় না, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যায় না। এক দিন সে নাদিয়াকে বলে, ‘এবার আমি এই চাকরিটা ছাড়ব। এরপর ইসরাইলে চলে আসব। তোমাদের ছেড়ে আর দূরে দূরে থাকতে চাই না আমি।’
নভেম্বর শেষ হতে চলল। এবার এলির বিদায়ের পালা। এলি তার স্ত্রী নাদিয়া ও তিন সন্তানকে বিদায়ী চুম্বন দিয়ে বিমান চড়ে বসল। নাদিয়া জানত না যে, এ বিদায়ই এলির শেষ বিদায়।
১৯৬৪ সালের ১৩ নভেম্বর। সীমান্তের ওপারে বেসামরিক এলাকা তেল-দানে জমি চাষ করছিল একটি ইসরাইলি ট্রাক্টর। হঠাৎ সেটিকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু হলো এপার অর্থাৎ সিরিয়ান সীমান্তরক্ষীদের তরফ থেকে। আর যায় কোথায়! ইসরাইল যেন তৈরি হয়েই ছিল। শুরু হলো ট্যাংক ও কামান থেকে ভারী গোলাবর্ষণ। কয়েক মিনিটের মাথায় তার সাথে এসে যোগ দিলো মিরেজ ও বাউটুর জঙ্গি বিমান। সেগুলো সিরিয়ান সামরিক অবস্থানে হামলে পড়ল। এরপর জর্দান নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য সিরিয়া যেখানে খাল খনন করছিল, সেখানেও ছুটে গেল বিমানগুলো। ভারী ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম, বুলডোজার, ট্রাক্টর, শাবল সবই একে একে ধ্বংস করে দিলো। জবাবে সিরিয়ান বিমানবাহিনীর টিকিটিও দেখা গেল না। তারা কিছু দিন আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিগ জঙ্গি বিমান কিনেছিল, কিন্তু এগুলো হয়তো ভালোভাবে ব্যবহার করতে শেখেনি।
বিশ্ব মিডিয়া একসুরে সিরিয়ান হামলার নিন্দা এবং আগ্রাসনের জবাবে ইসরাইলের প্রশংসা করতে থাকে।
কয়েক মাস পরে সিরিয়ার অফিসাররা জানান, ইসরাইলি হামলার অন্যতম স্থপতি ছিল এলি কোহেন। হামলার সময়ও সে ইসরাইলেই ছিল। এলির কারণেই ইসরাইলিরা জানতে সক্ষম হয় সিরিয়ান বিমানবাহিনীর দীনহীন অবস্থার কথা। জানতে পারে, ওই সময় কোনো রকম যুদ্ধ করার ক্ষমতাই সিরিয়ান বিমানবাহিনীর ছিল না। সীমান্তে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা দুর্গ এবং নদীপথ পরিবর্তন কার্যক্রম সম্বন্ধেও বিস্তারিত জানত ইসরাইল। আরো জানত, সিরিয়ার প্রতিটি সীমান্ত ঘাঁটি ও বাঙ্কারে কোন অস্ত্র কী পরিমাণ মজুদ আছে। এই জানার সবই এলির কল্যাণে।
তবে এলি কোহেন জানত তাদের চেয়েও বেশি। সে ইতোমধ্যে এক দোস্ত জুটিয়ে ফেলেছিল। এই দোস্ত একজন সৌদি উদ্যোক্তা। জর্দান নদীর গতিপথ পরিবর্তনে সিরিয়া যে প্রকল্প নিয়েছে তার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ঠিকাদারি পেয়েছিল এই উদ্যোক্তা। এলির সাথে এই সৌদি ঠিকাদারের দোস্তির সুবাদে ইসরাইল কয়েক মাস আগেই জেনে যায়, কোথায় খাল খননের কাজটি চলবে, এর গভীরতা ও প্রস্থ কতটা হবে, খাল খননে কী ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহৃত হবে ইত্যাদি সবরকম কারিগরি তথ্য। সৌদি ঠিকাদারটি তার দোস্ত এলি কোহেনকে আরো জানিয়ে দেয় কী ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জানায়, এমনকি বিমান থেকে বোমা ফেললেও তা থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া আছে। এলি কোহেনের এই প্রাণের বন্ধুটির নাম বিন লাদেন, পরবর্তীকালের ‘বিশ্ববিখ্যাত’ জঙ্গি নেতা ওসামা বিন লাদেনের পিতৃদেব। এই মহাশয়টিই ইসরাইলি গুপ্তচর এলিকে তার প্রকল্পের সব তথ্য জানিয়ে দেয়।
এরপর ইসরাইল আরো কয়েকবার এই প্রকল্পের ওপর হামলা চালায়। ১৯৬৫ সালে আরব দেশগুলো প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পরই ইসরাইল হামলা বন্ধ করে।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইসরাইল ছাড়ে এলি। তার কয়েক সপ্তাহ পর নাদিয়া কোহেনের মেইল বক্সে চমৎকার একটি পোস্টকার্ড আসে। তাতে ফরাসি ভাষায় এলি লিখেছে, ‘প্রিয়তমা নাদিয়া, নববর্ষের শুভেচ্ছা নিয়ো। আমাদের পরিবারে নতুন বছরটি নিয়ে আসুক সুখের ফোয়ারা। আমার প্রিয়তম ফিফি (সোফি), আইরিশ ও শেখের (শাউল) জন্য রইলো অনেক অনেক আদরমাখা চুম্বন। আর তোমার জন্য আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে থাকল ভালোবাসা। এলি।’
ইসরাইলের বাসায় বসে নাদিয়া যখন পোস্টকার্ডটি পড়ছে, এলিকে তখন দামেস্ক কারাগারের কর্কশ পাথুরে মেঝেতে শুইয়ে বেদম পেটানো হচ্ছে।
ইসরাইলের বাসায় বসে নাদিয়া যখন পোস্টকার্ডটি পড়ছে, এলিকে তখন দামেস্ক কারাগারের কর্কশ পাথুরে মেঝেতে শুইয়ে বেদম পেটানো হচ্ছে।
কয়েক মাস ধরেই সিরিয়ান মুখাবারাত অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তক্কে তক্কে ছিল। তবে সতর্কতা সঙ্কেতটা প্রথম এসেছিল মুখাবারাতের প্যালেস্টাইন বিভাগের প্রধান চিফ তায়ারার পক্ষ থেকে। ১৯৬৪ সালে তায়ারার নজরে আসে, সিরিয়া সরকার সন্ধ্যায়, এমনকি রাতেও যে সিদ্ধান্তই নিক, পরদিনই তা ইসরাইলের সরকারি রেডিও কোল ইসরাইলের আরবি ভাষার প্রোগ্রাম থেকে প্রচার করা হয়। এ ছাড়া ইসরাইল এমন কিছু অতিগোপনীয় সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দেয়, যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল রুদ্ধদ্বার কক্ষে। ১৩ নভেম্বরের ঘটনায় ইসরাইল যেভাবে ‘একেবারে ঠিক জায়গাটিতে’ বোমা ফেলেছে, তাও তায়ারাকে হতবাক করে। তিনি ভাবেন, এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? তিনি অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, রণাঙ্গনে সিরিয়ান আর্মি মোতায়েন সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গিয়েছিল ইসরাইল এবং বুঝে ফেলেছিল কোথায়, কিভাবে আঘাতটা হানতে হবে। সব দিক বিবেচনা করে তায়ারা নিশ্চিত হলেন, সিরিয়ান সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ে ইসরাইলের একজন গুপ্তচর অবশ্যই আছে। ওই গুপ্তচরই সিরিয়ান সরকারের সব সিদ্ধান্ত ইসরাইলকে জানিয়ে দেয় এবং কোল ইসরাইল রেডিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো সম্প্রচার করে। বোঝা যায়, গুপ্তচরটি ওয়্যারলেসের সাহায্যে খবরগুলো ট্রান্সমিট করছে। তায়ারা ভাবেন, কোথায় সেই ট্রান্সমিটার?
১৯৬৪ সালের শরৎকালে তায়ারা ট্রান্সমিটারটি খুঁজে বের করার জন্য বড় ধরনের কার্যক্রম নিলেন। এ কাজে সোভিয়েত-নির্মিত সরঞ্জাম ব্যবহার করলেন। কিন্তু না, কোথাও খোঁজ মিলল না।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে ভাগ্য তাদের প্রতি প্রসন্ন হলো। সেবার লাতাকিয়েহ সমুদ্রবন্দরে এলো একটি সোভিয়েত জাহাজ। জাহাজভর্তি বড় বড় কনটেইনারে করে এসেছে নতুন যোগাযোগ সরঞ্জাম। সিরিয়ান সেনাবাহিনীর পুরনো যোগাযোগ সরঞ্জাম বদলে এসব নতুন সরঞ্জাম বসানো হবে। কাজটি হলো ১৯৬৫ সালের ৭ জানুয়ারি। পুরনো সরঞ্জাম সব ফেলে দিয়ে যেহেতু নতুনগুলো বসানো হবে, তাই সেনাবাহিনীর সবরকম কমিউনিকেশন ২৪ ঘণ্টার জন্য সাসপেন্ড (স্থগিত) করা হলো।
সারা দেশে সব আর্মি কমিউনিকেশনে তখন নিñিদ্র নীরবতা। এরই মধ্যে ডিউটিরত এক অফিসারের আর্মি রিসিভারে শোনা গেল একটি দুর্বল ট্রান্সমিশনের ক্ষীণ আওয়াজ। গুপ্তচরের ট্রান্সমিশন! অফিসারটি তৎক্ষণাৎ টেলিফোনের সন্ধানে ছুটলেন।
ফোন পেয়েই চঞ্চল হয়ে উঠল মুখাবারার স্কোয়াড। তাদের হাতে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি লোকেটর, যা মুহূর্তের মধ্যেই ট্রান্সমিশনের উৎস খুঁজে বের করে ফেলতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু টেকনিশিয়ানদের ক্যালকুলেশন বারবার একটি জায়গার দিকেই আঙুল তুলতে লাগল : কামাল আমিন তাবেতের বাড়ি।
মুখাবারাতের একজন সিনিয়র অফিসার এ কথা শুনেই উড়িয়ে দিলেন : ‘এ হতেই পারে না। বাথ পার্টির নেতারা যাকে আগামী মন্ত্রিসভার সদস্য বানাতে চাচ্ছেন, সেই কামাল আমিন তাবেত গুপ্তচর! ভাবাই যায় না। তাবেত সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে।’
সেদিন সন্ধ্যায় আবার ট্রান্সমিশন। মুখাবারাত আবার তাদের গাড়ি পাঠাল। ফলাফল পূর্ববৎ।
জানুয়ারি মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে আবু রামেন এলাকার চমৎকার বাড়িটির সদর দরজা ভেঙে সেখানে ঢুকে পড়ল মুখাবারাতের চারজন অফিসার। তাদের হাতে অস্ত্র। তারা বাড়ির বেডরুমে ঢুকে পড়ল। গুপ্তচরটি সেখানেই ছিল, তবে বিছানায় নয়, সে তখন ট্রান্সমিট করছিল। অফিসারদের দেখে সে উঠে দাঁড়াল। তবে সে না চেষ্টা করল পালাতে, না অফিসারদের ঠেকাতে। কমান্ডিং অফিসার জলদগম্ভীর গলায় বললেন, কামাল আমিন তাবেত, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!’
তাবেতের গ্রেফতারের খবরটি দামেস্কে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ফ্যান্টাস্টিক, অ্যাবসার্ড, ইম্পসিবল, ননসেন্স! সিরিয়ার নেতারা খবরটি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা, স্বয়ং প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বন্ধু, একজন কোটিপতি ও সমাজসেবী কী করে গুপ্তচর হতে পারেন? এ তো অবিশ্বাস্য!
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যই বটে, তবে প্রমাণও অকাট্য। যে ট্রান্সমিটার তাবেত তার বাড়ির জানালার শাটারে লুকিয়ে রাখত, যে ছোট রিজার্ভ ট্রান্সমিটারটি রাখা হতো লিভিং রুমের বিশাল ঝাড়বাতিতে, সবই উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মাইক্রোফিল্ম, ডিনামাইটযুক্ত সিগার, গোপন সঙ্কেত লেখা কাগজ ... সব।
তাবেতের গ্রেফতারের খবরটি দামেস্কে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ফ্যান্টাস্টিক, অ্যাবসার্ড, ইম্পসিবল, ননসেন্স! সিরিয়ার নেতারা খবরটি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা, স্বয়ং প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বন্ধু, একজন কোটিপতি ও সমাজসেবী কী করে গুপ্তচর হতে পারেন? এ তো অবিশ্বাস্য!
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যই বটে, তবে প্রমাণও অকাট্য। যে ট্রান্সমিটার তাবেত তার বাড়ির জানালার শাটারে লুকিয়ে রাখত, যে ছোট রিজার্ভ ট্রান্সমিটারটি রাখা হতো লিভিং রুমের বিশাল ঝাড়বাতিতে, সবই উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে মাইক্রোফিল্ম, ডিনামাইটযুক্ত সিগার, গোপন সঙ্কেত লেখা কাগজ ... সব।
এ ঘটনায় শাসকগোষ্ঠী কেঁপে উঠল। তারা আদেশ দিলো ব্যাপক তদন্তের। বলা হলো, তাবেত আসলে কে খুঁজে বের করো। প্রেসিডেন্ট হাফিজ স্বয়ং একদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তার সেলে এলেন। পরে তিনি বলেন, ‘যখন আমি তাবেতের চোখের দিকে তাকালাম, তখন হঠাৎ এক ভয়ানক সংশয়ে আমার মন জর্জরিত হয়ে উঠল। আমার মনে হলো, আমার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, সে মোটেই আরব নয়। খুব বেছে বেছে আমি তাকে ইসলাম ধর্ম ও কুরআন সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত করতে বললাম। সে দু-একটি আয়াত বলতে পারলেও পুরোটা পারেনি। এর কৈফিয়ত হিসেবে সে বলতে চাইল খুব অল্প বয়সে সে সিরিয়া ছেড়ে চলে যায়। কাজেই সে এগুলো কিছুই ভালোভাবে মনে করতে পারছে না। কিন্তু ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি যে, সে একজন ইহুদি।’
এরপর তার ওপর চলল প্রচণ্ড নির্যাতন। মারের চোটে সে অজ্ঞান হয়ে গেল। তার মুখে ও সারা শরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন। তার নখ তুলে ফেলা হয়েছে। এভাবে তার কাছ থেকে আদায় করা স্বীকারোক্তি জেনারেল হাফিজের কাছে পৌঁছে দেয়া হলো। জানা গেল, সে তাবেত নয়, এলি কোহেন; একজন ইসরাইলি ইহুদি।
১৯৬৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসরাইলি গুপ্তচর’কে গ্রেফতারের কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করল দামেস্ক। সাথে সাথেই নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল দামেস্কে : এলি কোহেন কি একা, না তার সাথে আরো কেউ ছিল? শুরু হলো ধরপাকড়। একে একে গ্রেফতার হলো ৬৯ জন, তাদের মধ্যে ২৭ জন মহিলা। এই গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল মাজিদ শেখ এল-আরদ, জর্জ সালেম সেইফ, লেফটেন্যান্ট জাহের আল-দীন, প্রচার মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা এবং বেশ ক’জন মহিলা, যাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তাবেতের সাথে যোগাযোগ ছিল এমন চার শ’ লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো।
তদন্ত চালাতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলো। কেননা, সিরিয়ার রাজনৈতিক, সামরিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন তাবেতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তদন্তকারীরা তাদের ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না। জনমনে তাদের নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে এই ভয়ে তাদের নামও বলা হলো না। সিরিয়ানরা দেখতে পেল, তাবেত তার বিভিন্ন ক্ষেত্রের তথ্যদাতাদের নাম যাতে প্রকাশ না পায়, তার সম্ভবপর সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে। কাজেই গুপ্তচর চক্রটির আওতা নির্ধারণ করাটা খুবই জটিল হয়ে দাঁড়াল।
এ দিকে তাবেতের গ্রেফতার হওয়ার খবরটি একেবারে চেপে যেতে চাইল ইসরাইল। তারা খবরটি প্রকাশের ওপর মিলিটারি সেন্সরশিপ আরোপ করল। তারা তখনো আশা করছিল যে, এলিকে বাঁচানো সম্ভব এবং তাই খবরটি ইসরাইলি মিডিয়ায় কোনোভাবেই প্রকাশ করতে না দেয়ার বিষয়ে কৃতসঙ্কল্প হলো। কিন্তু তার পরও কিছুটা জানাজানি হয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় এক অতিথি এলো এলির ভাইদের বাসায়। বলল, ‘তোমাদের ভাই দামেস্কে গ্রেফতার হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইসরাইলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে।’ শুনে ভাইয়েরা তো হতবাক! তাদের একজন, মরিস, ছুটে গেল বেত ইয়ামে মায়ের বাসায়, ‘মা, তুমি একটু শক্ত হও। শোনো, এলি সিরিয়ায় গ্রেফতার হয়েছে।’
শুনে বৃদ্ধার মুখে দিয়ে আর কথা বের হয় না। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে অতি কষ্টে বললেন, ‘সিরিয়া? সে সিরিয়া গেল কখন?’ মরিস মাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেই বৃদ্ধা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।
খবরটা পেল নাদিয়াও। স্বামী তাকে ‘সব কথা’ বলছে না এমন একটা সন্দেহ তার সবসময় ছিলই, কিন্তু সত্যি সত্যিই সে কী কাজ করে, তা জানত না। সব শুনে এখন সে একেবারে ভেঙে পড়ল। এলির সহকর্মীরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। একজন বলল, ‘আপনি প্যারিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। আমরা সেখানকার সেরা আইনজীবীদের আনার চেষ্টা করব। এলিকে বাঁচানোর জন্য যা কিছু করা দরকার, সবই আমরা করব।’ এলির সাবেক বস মেইর অ্যামিত এলিকে উদ্ধারের কার্যক্রম ব্যক্তিগতভাবে নিজের কাঁধে নিলেন।
৩১ জানুয়ারি ফ্রান্সের অন্যতম সেরা আইনজীবী জাক মারসিয়ার এলেন দামেস্কে। কাগজে-কলমে তাকে আনিয়েছিল এলি কোহেনের পরিবার, তবে আসলে সব ব্যয় বহন করছিল ইসরাইল সরকার। জাক মারসিয়ার সিরিয়া এলেন মিশন ইম্পসিবল নিয়ে। পরে তিনি বলেন, দামেস্কে আমার প্রথম দিনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এলি কোহেনের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করছিলাম খানিকটা সময় পাওয়ার, যাতে তাকে বাঁচানোর জন্য কোনো চুক্তি করা যায় কি না তা দেখতে।
মারসিয়ার একে একে দেখা করলেন সরকারের অনেক নেতার সাথে। বললেন, ‘আমাকে একটু আসামির সাথে দেখা করার সুযোগ দিন। আমি যে তার আইনজীবী হিসেবে কাজ করব, সেই দলিলে তার (এলি) সই তো লাগবে!’
মারসিয়ারের আবেদন কানেই তুলল না কর্তৃপক্ষ, সোজা ‘না’ করে দিলো। তবে মারসিয়ার দু-এক দিনের মধ্যেই লক্ষ করলেন, সরকারি কোনো কোনো মহলে এলির এমন সব বন্ধু আছেন, যারা বিশ্ব জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে ওরা সামরিক বাহিনীর একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর এই অংশটি প্রেসিডেন্ট হাফিজকে দু’চোখে দেখতে পারে না। তারা চাচ্ছে প্রেসিডেন্টের সাথে এলির দোস্তির বিষয়টি প্রকাশ্য আদালতের মাধ্যমে প্রকাশ করে দিতে। তারা ভাবছে, তাহলে শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতির কথা সাধারণ মানুষ জেনে যাবে এবং জনগণের কাছে তারা ছোট হয়ে যাবে।
তাদের এই ভাবনা ও তৎপরতার চরম বিরোধী হয়ে দাঁড়াল আরেকটি পক্ষ। এরা তারা, যারা এলি বা তাবেতের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখত। তারা জানত, প্রকাশ্য বিচার হলে তাদের অনেককেও ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। তাই তারা একটা লক্ষ্যই স্থির করে : যেকোনো মূল্যে প্রকাশ্য বিচার ঠেকানো এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া।
অবশেষে এক বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার শুরু হলো। একটি খালি কক্ষের সামনে আরেকটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে চলল বিচারকার্যক্রম। এর নির্বাচিত অংশই কেবল সরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হলো। সরকার বা আসামিপক্ষ কারোই কোনো আইনজীবী ছিল না। এলি যখন তার পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগের জন্য আবেদন জানাল, বিচারক তখন ক্ষোভে ফেটে পড়লেন : ‘তোমার কোনো আইনজীবী লাগবে না। সব দুর্নীতিবাজ পত্রিকা তোমার পক্ষ নিয়েছে। বিপ্লবের শত্রুরা সবাই তোমার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে।’ পুরো প্রক্রিয়ায় প্রিসাইডিং জজ নিজেই পালন করেছেন প্রশ্নকারী, কৌঁসুলী ও বিচারকের ভূমিকা। এই জজ ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালাহ দীন, এলি কোহেনের সাবেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিচারকদের মধ্যে তার আরো এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন কর্নেল সালিম হাতুম। এলির সাথে তার বন্ধুত্বের ‘গুজব’কে ভুল প্রমাণিত করতে তিনি আদালত কক্ষেই এক নাটক করে বসেন। তিনি এলি কোহেনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি সালিম হাতুমকে চেনো?’ আসামি তখন দক্ষ অভিনেতার মতো শূন্য আদালতকক্ষের দিকে তাকায়, তারপর চোখ ফেরায় হাতুমের দিকে এবং জবাব দেয়, ‘না, এই রুমে আমি তাকে দেখছি না।’
বিচারকার্যক্রমের এই অংশটি টেলিভিশনে দেখানো হয়। মারসিয়ের বলেন, ‘এই অংশটি দেখে গোটা দামেস্ক হেসে উঠেছিল।’ তিনি বলেন, ‘আসলে ওটা কোনো বিচার ছিল না, ওটা ছিল একটা ট্র্যাজিকমেডি (বিয়োগান্তক কৌতুকনাট্য)। একটা সার্কাস।’
টেলিভিশন ক্যামেরায় এলির সাথীদেরও দেখানো হলো : এল-আরদ, এল-দীন, সেইফ ও কয়েকজন পতিতা। কিন্তু অন্য মহিলারা কারা? তারা কি সিনিয়র অফিসারদের স্ত্রী? ব্যক্তিগত সচিব? তাবেত ও বাথ পার্টি নেতাদের বান্ধবী? কী ধরনের তথ্য ইসরাইলে পাঠাত এলি? তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে, কিন্তু সে কী কাজ করেছে এবং কোন ধরনের তথ্য পাচার করেছে সে বিষয়ে বিচার চলাকালে একটি শব্দও বলেনি।
গোটা বিচারপ্রক্রিয়াটি ইসরাইল নীরবে দেখেছে। এলির পরিবারকে একটি টিভি সেট ধার দিয়েছিল মোসাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওতে বিচারকার্যক্রম দেখত নাদিয়া, তার ছেলেমেয়ে ও এলির ভাইয়েরা টিভির পর্দায় যখনই এলির ছবি ভেসে উঠত, তারা সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠত। আর তার বৃদ্ধা মা ছুটে গিয়ে টিভির পর্দায় চুমু দিতেন আর গলার চেনে ঝোলানো ডেভিডের তারাটি ছেলের চেহারার ওপর চেপে ধরতেন! ছোট্ট সোফি বলত : ‘এটা আমার বাবা! বাবা বীর!’ মেয়ের কথা শুনে নীরবে চোখের পানি ফেলত নাদিয়া।
এদিকে এলির ফরাসি আইনজীবী মেরসিয়েরও শান্তিতে ছিলেন না। দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত তার। সারা শরীর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা। তার অন্তর্জ্ঞান তাকে গভীর হতাশায় ফেলে দিয়েছিল।
এদিকে এলির ফরাসি আইনজীবী মেরসিয়েরও শান্তিতে ছিলেন না। দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত তার। সারা শরীর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা। তার অন্তর্জ্ঞান তাকে গভীর হতাশায় ফেলে দিয়েছিল।
৩১ মার্চ সামরিক আদালত রায় ঘোষণা করল : এলি কোহেন, মাজিদ শেখ এল-আরদ ও লেফটেন্যান্ট জাহের আল-দীনের মৃত্যুদণ্ড।
আইনজীবী মেরসিয়ের এবার নতুন তৎপরতা শুরু করলেন। এপ্রিল ও মে মাসে তিনি তিনবার দামেস্ক সফরে গেলেন। তিনি ইসরাইলের কাছ থেকে সিরিয়ার জন্য সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব নিয়ে এলেন। তার প্রথমটি এ রকম : কোহেনের জীবনের বিনিময়ে সিরিয়াকে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের ওষুধ ও কৃষিসরঞ্জাম দেবে ইসরাইল। সিরিয়া প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করল। এবার ইসরাইলের দ্বিতীয় প্রস্তাব : ইসরাইলের জেলখানায় আটক ১১ জন সিরিয়ান গুপ্তচরকে ছেড়ে দেয়া হবে। সিরিয়া এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করল, তবে আভাস দিলো যে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা ঘোষণার একটি বিষয় কিন্তু আছে।
১ মে এল-আরদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হলো। ৮ মে এলির সাজার বিষয়টি সরকারিভাবে প্রকাশ করা হলো। এবার শেষ চেষ্টায় নামল মোসাদ। এলিকে ক্ষমার আবেদন জানিয়ে প্যারিসে সিরিয়ান দূতাবাসকে চিঠি দিলো নাদিয়া। এ ছাড়া সারা বিশ্ব থেকেই তাকে ক্ষমা করার জন্য আবেদন আসতে লাগল। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বের বরেণ্য সব ব্যক্তিত্ব। যেমন, পোপ ষষ্ঠ পল, ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল, ফ্রান্সের এডগার ফুয়রে ও আন্তোনিও পিনাইর মতো রাষ্ট্রনায়ক, বেলজিয়ামের রানিমাতা এলিজাবেথ এবং রাজনীতিবিদ ক্যামিলে হুইজম্যানস, কানাডার রাজনীতিবিদ জন ডিফেনবেকার, ইতালির ধর্মযাজক ও মন্ত্রীবর্গ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ২২ সদস্য, হিউম্যান রাইটস লিগ, ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস প্রভৃতি।
১৮ মে মাঝরাতে কারা কর্মকর্তারা এসে এলি কোহেনের ঘুম ভাঙালেন। তারা তাকে একটি সাদা লম্বা গাউন পরিয়ে দিলেন এবং দামেস্কের বাজার এলাকায় নিয়ে গেলেন। তারা তাকে তার পরিবারের কাছে একটি চিঠি লেখার এবং দামেস্কের রাব্বি (ইহুদি ধর্মগুরু) নিসিম অ্যান্দাবোর সাথে কিছু কথা বলার সুযোগ দিলেন। সৈন্যরা এবার গলায় একটি বড় পোস্টার ঝুলিয়ে দিলো। ওতে তার সাজার বিষয়টি আরবিতে লেখা ছিল। দুই সারি সশস্ত্র সৈন্যের মাঝখান দিয়ে এলি হেঁটে গেল ফাঁসির মঞ্চের দিকে। তখন টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের আলোকচিত্রীদের ক্যামেরা মুহুর্মুহু ঝলসে উঠছিল।
জল্লাদ প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে দেরি না করে এলির গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিলো এবং তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো ফাঁসির মঞ্চে।
এলির সামনে জনতা। নিঃশব্দ, কিন্তু পরাজিত নয়। চার দিকে এতই নৈঃশব্দ্য যে কেউ নিঃশ্বাস ফেললে তার শব্দও বুঝি শোনা যাবে। জল্লাদ এবার আসামির পায়ের নিচ থেকে পাটাতনটি একটানে সরিয়ে নিলো। ইসরাইলি গুপ্তচরের ফাঁসির দৃশ্য দেখে সমবেত নারী-পুরুষেরা উল্লাসধ্বনি দিয়ে উঠল।
সেই রাতে দামেস্কের বেশির ভাগ মানুষই জেগে ছিল। পরবর্তী ছয় ঘণ্টা তারা ফাঁসির মঞ্চের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে এলির লাশ দেখেছে।
এ দিকে ইসরাইলেও এত দিনকার নৈঃশব্দ্যের ভারী পর্দাটি মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এলি কোহেন পরিণত হলো জাতীয় বীরে। কয়েক লাখ মানুষ শোক জানাল এলির পরিবারকে। তার নামে অসংখ্য স্কুল, রাস্তা ও পার্কের নামকরণ করা হলো। তার কৃতিত্ব বর্ণনা করে লেখা হলো অসংখ্য প্রবন্ধ ও বই।
এলির শেষ চিঠির কথা রাখেনি তার প্রিয়তমা পত্নী নাদিয়া। এলি লিখেছিল, আবার বিয়ে করতে পারো। কিন্তু নাদিয়া আর বিয়ে করেনি। তবে সে তার প্রিয়তম স্বামীর কবরটিও দেখতে পায়নি। কারণ, সিরিয়া কখনোই এলির লাশ ফেরত দেয়নি।
পাদটীকা : এলিকে বলা হয়, মোসাদ হিরোদের একজন। এ নিয়ে দেশটিতে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু মোসাদের ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক আছে। অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বইতে বারবার বলা হয়েছে, মোসাদের অসংযত আচরণের শিকার এলি। মোসাদ অকারণে তাকে প্রতিদিন, এমনকি দিনে দু’বারও রিপোর্ট ট্রান্সমিট করতে বাধ্য করেছে। শুধু তা-ই নয়, সিরিয়ান পার্লামেন্টের বিতর্কও প্রতিদিন ট্রান্সমিট করতে নির্দেশ দিয়েছে তাকে। অথচ এসবের গোয়েন্দামূল্য বলতে গেলে শূন্য। এসব অর্থহীন কাজই এলিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। মোসাদ-কর্তাদের অতি আত্মবিশ্বাস ও বাড়াবাড়িই এলির করুণ মৃত্যু ডেকে এনেছে বলে মনে করেন ইসরাইলের অসংখ্য মানুষ।
Comments
Post a Comment