লাল গোলাপ
জোবায়ের রাজু
ভালোবাসেনি, যতটা বেসেছে সাজ্জাদ। বিন্দুর মতো স্ত্রীকে অবশ্য ভালো নাও বেসে পারা যায় না। এ কী অপরূপ নিয়ে জন্মেছে বিন্দু। ডাগর চোখের চাহনী আর অদ্ভুত মায়াময় মুখখানি দেখলে এমনিতেই মন ভরে যায় সাজ্জাদের।
মাত্র দুই মাস আগে গ্রামের বাড়ি থেকে বিয়ে করে শহরে বিন্দুকে নিয়ে এসেছে সাজ্জাদ। দু’জনের একলা সংসার। সাজ্জাদ রোজ সকালে অফিসে চলে যাওয়ার পর সারা দিন একাই ঘরে থাকে বিন্দু। শহুরে জীবন তার পছন্দের না। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি বিন্দুকে শহরে থাকার অনুমতি দিয়েছেন তাদের একমাত্র ছেলের সেবা যত্নের জন্য। প্রথমে শহরে আসার ব্যাপারে সে বেশ আগ্রহী হলেও এখানে এসে তার সেই আগ্রহ ফিকে হয়ে গেছে। ডিশ লাইন থাকার পরও টিভি চালু না করার কারণ হচ্ছে বিন্দুর টিভিতে সে রকম তীব্র কোনো রুচি নেই।
সাজ্জাদ যতক্ষণ বাসায় থাকে, ততক্ষণই বিন্দুর ভালো লাগে। মানুষটি যে হাজার রকমের গল্প শোনায় তাকে। মধ্যরাত অব্দি শুয়ে শুয়ে দু’জন গল্পের আসর জমায়।
২.
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সাজ্জাদ সেই সকালেই অফিসে চলে গেছে। সাংসারিক কাজকর্মে বিন্দু যখন নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে নিচ্ছিল, তখন সকাল সাড়ে ৮টা। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। এ অসময়ে দরজার ওপারের মানুষটি কে হতে পারে, বারবার অনুমান করেও ব্যর্থ হয়ে বিন্দু দরজা খুলে দেখে বাইরে সাজ্জাদ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে লাল টকটকে কতগুলো গোলাপ ফুল। বিন্দুর দিকে গোলাপগুলো এগিয়ে দিয়ে সাজ্জাদ বলল, ‘এই নাও ফুল। ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। মনেই ছিল না আজ ভালোবাসা দিবস। অফিসে যাওয়ার পথে দেখি সারাটি শহর গোলাপে গোলাপে চেয়ে গেছে। ভাবলাম তোমার জন্য কিছু গোলাপ কিনে...।’ সাজ্জাদের কথা শেষ না হতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল বিন্দু। এই মানুষটি তাকে এত পাগলের মতো ভালোবাসে কেন, কে জানে।
লাল টকটকে গোলাপগুলো বিন্দুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাজ্জাদ পুনরায় অফিসমুখী হওয়ার পর দরজা বন্ধ করে বিন্দু তার শোবারঘরে ফিরে এলো। সাজ্জাদের ভালোবাসার উপহার গোলাপগুলো বালিশের পাশে রাখতেই হঠাৎ সাব্বিরকে মনে পড়ল বিন্দুর।
স্টাডি লাইফে সাব্বির বেপরোয়া জ্বালাত বিন্দুকে। বিন্দু সাব্বিরকে সরাসরি না করে দিলেও পিছু ছাড়েনি সাব্বির। রোজ কলেজে এলে সে ছলে বলে কৌশলে বিন্দুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মরিয়া হয়েও বারবার ব্যর্থ হতো। বিন্দু তাকে পাত্তাই দিত না। বারবার অপমান করার পরও বিন্দু দেখত অসভ্য পাজিটা খুব সহজে তার দেয়া সব অপবাদ মাথা পেতে নেয়। তবুও বেচারা সাব্বির বেহায়ার মতো বিন্দুকে চকলেট, চুইংগাম থেকে শুরু করে কখনো কখনো প্রেমপত্র পাঠাত। পত্রের আকর্ষণীয় ভাষা পড়ে বিন্দু কড়ায় গণ্ডায় টের পেত সাব্বিরের আবেগময় ভালোবাসার গভীরতা। কিন্তু সে ছিল নিরুপায়। কারণ সাব্বিরকে তার ভালো লাগত না। ভালোবাসা তো ভালো লাগারও একটা ব্যাপার।
তার পর বিন্দু একদিন কলেজের দোতলার বারান্দায় একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাব্বিরকে। ভালোবাসার পুরনো আহ্বান নিয়ে সে আবার বিন্দুকে মনের সব অব্যক্ত কথা বলে গোলাপগুলো এগিয়ে দিতেই বিন্দু আগের মতো অস্বীকৃতি জানায়। তবু সাব্বির নাছোড়বান্দা। বারবার গোলাপগুলো এগিয়ে দিয়ে ভালোবাসা নিবেদন করে বলে মেজাজ বিগড়ে যায় বিন্দুর। রাগে ক্ষোভে সে সাব্বিরের দেয়া গোলাপগুলো হাতে নিয়ে কলেজের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। এমন কাণ্ডে এই প্রথম নিজেকে অপমানিত বোধ করে সাব্বির। দীপ্ত গলায় প্রশ্ন করে- ‘তুমি আমাকে ভালোবাসবে না, এই তো?’ বিন্দু একবাক্যে জানিয়ে দেয়- ‘কক্ষনো না’। সাব্বির অসহায়ের মতো বলে- ‘তাহলে এই জীবন আর রাখব না’। এই বলে সে এত দৌড়ে চলে যায় কলেজের ছাদে।
তার পর সবার চোখের সামনে ঘটল সেই অঘটন। সাব্বির ছাদ থেকে নিচে লাফ দেয়। সারা কলেজ আতঙ্ক। হাসপাতালে নেয়া হয় সাব্বিরকে। চিকিৎসক জানায় সাব্বিরের মৃত্যু সংবাদ। বিন্দুর ভালোবাসা পায়নি বলে জীবন দিয়ে দিলো সাব্বির।
এ ঘটনার পর বিন্দু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সাব্বির এমন একটি কাজ করবে, ধারণাই করেনি সে। এখন সে বুঝতে পারছে সাব্বির তাকে কতটা ভালোবাসত।
আজ সংসার হয়েছে বিন্দুর। সাজ্জাদ তার স্বামী। এই শহর আজ তার ঠিকানা।
সাজ্জাদের দেয়া গোলাপগুলোতে আলতো করে হাত বোলায় বিন্দু।
Comments
Post a Comment