ভালোবাসা নেই

ভালোবাসা নেই

মুহাম্মাদ আবদুল্লাহিল বাকী
মুনতাহা একেবারে নাছোড়বান্দা। রিমিকে না নিয়ে বেড়াতে বেরোবে না। এই বেড়াতে যাওয়া নিয়ে এ ক’দিনে রিমিকে যে কতবার মোবাইল করেছে, তার হিসাব নেই। আজ সকালেও রিমিকে মোবাইল করেছে মুনতাহা। মোবাইলে বলে, ‘মুনতাহা, ঠিক করে বল, বেড়াতে যাবি কি না? শোন, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা, বাঘাইছড়ি দারুণ জায়গা। কত মজা হবে ওখানে! বল তো, কদ্দিন একসাথে বেড়াতে যাইনি?’ 

তা বেড়ানোর কথায় রিমি দশ পা এগিয়ে। আর পলাশও রাজি সাথে সাথে। তবে বিয়ের পর মুনতাহার সাথে বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম এই প্রথম। বিয়ের আগে দু’বান্ধবী কতবার যে একসাথে বেড়াতে বেরিয়েছে, তার হিসাব নেই। তবে শুধু দু’বান্ধবী নয়, তখন বেড়াতে বেরত দু’বাড়ির সবাই।
এদিকে বেড়াতে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে শাশুড়িরও কী আনন্দ। খুশিতে উদ্বেল একেবারে। কী একটা কাজে রিমির রুমে আসাতে শাশুড়ি বলে ওঠেন, ‘বৌমা, অনেক দিন কোথাও যাইনি। কী একঘেয়ে লাগছে। যা হোক, এবার একটু হাঁফ ছাড়বে।’ 
শাশুড়ি পুকুরের দিকে যেতে যেতে রিমিকে বলেন, ‘বৌমা, সুযোগ পেলেই হইচই করে বেরিয়ে পড়ো। সবাই মিলে। বুঝলে, বেড়ানো মানেই শুধু পয়সা খরচা নয়। এক্সট্রা এনার্জি জোগাড় করা। এই এনার্জির জোরে শরীরটা হবে ঝরঝরে। আর কাজও করতে পারবে দ্বিগুণ উৎসাহে। তাই নয় কী? বলো?’
রিমি চুপ। তিরিক্ষি মেজাজ দেখে পলাশও যায় পিছু পিছু। দোতলায় পলাশকে নিজের ঘরে দেখতে পেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে রিমি। রেগেমেগে বলে, ‘শোনো, এক কথা, আমি বেড়াতে যাব না। কিছুতেই না।’ 
 কেন? কী হলো?’ পলাশ তীব্র কৌতূহলী। 
 ওরকম বেড়াতে যাবার দরকার নেই আমার। বেড়াতে গিয়ে তোমার মার হুকুম তামিল করতে থাকি আর কি।
দুই.
ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। এরকম ঘটনা সংসারে ঘটে থাকে। পলাশের এখনো মনে আছে ঘটনাটা। সেবার মা আর রিমিকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল সিলেট। তো সেবার সিলেটে বেড়াতে গিয়ে মাকে নিয়ে কী কাণ্ড! একে মায়ের শরীর বেশ ভারী। সাথে আবার বাতের রোগ। আবার মাও সহজে দমে যাওয়ার মানুষ নন। হালকা বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। মা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সবুজ প্রকৃতির কোলে সারি সারি পাহাড়ের দিকে। কী যে হয়, মা আচমকাই বলে বসেন, দাঁড়াও, এই সামনেরটায় একটু পায়চারি করে আসি। 
বারবার বারণ করেছিল পলাশ-রিমি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মনের আনন্দে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মা। আবার এমন জেদ, কাউকে সাথে নেবেন না। একাই গিয়েছিলেন। এ অবস্থায় পলাশের কী করার আছে! জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নজর রেখেছিল মায়ের দিকে। তবে পলাশ যা ভয় করেছিল, ঘটেওছিল তাই। ওই নড়বড়ে শরীর নিয়ে মা কেন পারবে চড়াই ভাঙতে। পা পিছলে পড়ে যান। আর একটু হলে চরম সর্বনাশ ঘটে যেত। একেবারে গড়িয়ে পড়তেন ২০০ মিটার গভীর খাদে। যা হোক, কপালের জোরে একজন ট্যুরিস্ট কোনোরকমে ধরে ফেলেছিলেন মাকে।
তারপর ক’দিন কী দুশ্চিন্তা আর কষ্টের একশেষ। মা হোটেলের বিছানায় শয্যাশায়ী। দু’পা আর ডান হাতে ব্যান্ডেজ। অথচ বাড়ি ফেরার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ক্যানসেল করাল রিটার্ন টিকিট। তবু হোটেল ম্যানেজারের ব্যবস্থাপনায় দু’একবার কাছেপিঠে পাঠিয়েছিল রিমিকে। কিন্তু তাতে কী আর মন ভরে?
রিমির মাথায় এখন আগুন। একবার তো নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অস্থির। রেগেমেগে বলে,‘শোনো, বেড়াতে বেরিয়েছি, না তোমার মার খিদমত খাটতে এসেছি?’
ভাগ্যিস, মা এখন ঘুমিয়ে। ঘুমের ট্যাবলেটের গুণে নাক ডাকছিল মায়ের। 
পলাশ তখন রিমিকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মোলায়েম অথচ বেশ গম্ভীর গলায় বলে,‘মার যা কাজটাজ, তোমার করতে হবে না। আমি করব। আর কোনো কথা আছে?’
রিমি কিন্তু গজগজ করে বলছিল সমানে, ‘কথার কী ছিরি! এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে পারে না, সে করবে কাজ।’ 
‘আরে বাবা, আসল কথাটা হলো, মা শুনতে পেলে কত দুঃখ পেত বলত!’ পরক্ষণে পলাশের গলা অতি মোলায়েম। 
‘তাতে কী! বাইরে বেরোতে কত বারণ করলাম! তা কথা শুনল?’ রিমি কিছু সময় চুপচাপ। তারপর চাপা অভিমানে বলেছিল,‘ঠিক আছে। এত যখন বাধা, আর বেড়াতে বেরোব না। তবে বলে রাখছি, ফের কখ্খনো আমার সামনে বেড়াতে যাওয়ার নাম করবে না।’ 
‘আহা, রাগছ কেন? শোনো, সংসারে সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। এত মাথা গরম করলে চলে?’ 
রিমির সাথে মায়ের এই মন কষাকষি গতবার বেড়াতে গিয়ে। 
তবে পলাশের কৌতূহল, গতবারের এই মন কষাকষির ব্যাপারটা এখনো কী ভুলতে পারেনি রিমি? আর সে-কারণেই কি সাথে নিতে চাইছে না মাকে? 
কিন্তু পলাশ ভেবে পায় না, সেই বিরক্তির আগুন কেনইবা এখনো পুষে রেখেছে রিমি?
তিন.
রিমি এখন দোতলায় নিজের রুমে। চুল পরিপাটি করছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পলাশ রিমির একেবারে কাছটিতে যায়। তারপর অতি মিহি গলায় বলে, ‘বুঝলে, এবার বেড়াতে গেলে দেখবে, মা ঠিক আমাদের কথামত চলবে। আর এতটুকু এপাশ ওপাশ করবে না।’ 
‘অসম্ভব। একটু স্বস্তিতে ঘুরতে বেড়াতে পারব? প্রতি মুহূর্তে দারোগাগিরি করবে। না হয় গোয়েন্দাগিরি।’
খোঁটাটা ধরতে পারে পলাশ। তাই, অতি ঠাণ্ডা গলায় রিমিকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে, ‘যা বলতে চাইছ বুঝেছি। সেন্টমার্টিনের কথা বলছ তো? কিন্তু তার জন্য মাকে দোষ দিও না। ব্যাপারটা বোঝ, পুত্রবধূ পানিতে নেমেছে সুইমিং কস্টিউম পরে, তা দেখে শাশুড়ি না দুটো কথা শুনিয়েছে। এতে রেগে যাওয়ার কী আছে?’ 
‘রাগব না? যুগ পাল্টেছে। আমার শখসাধ থাকতে নেই?’
‘আহা! ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? সহজভাবে নাও, ধরোনা, কথাটা বলেছে তোমার মা, তোমার শাশুড়ি নয়। তখন দেখবে, ব্যাপারটা অতি সাধারণ। এমন কিছু নয়। তা তোমার মা কী এমন দু’চারটা ব্যাপারে কোনোদিন কিছু বলেননি?’ 
‘না, আমার মা কখ্খনো নাক গলায় না এসব ব্যাপারে।’ 
‘ওহ্! এত জোরে কথা বলছ কেন? মা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। শুনতে পেলে কী ভাববে বল তো?’ 
‘ঠিক আছে। চুপ করলাম। তবে একটা কথা শুনে রাখো, আমি বেড়াতে যাব না। আমার কাছে আর বেড়াতে যাওয়ার নামও করবে না কোনো দিন। এখন বুঝতে পারছি, মুনতাহাকে বেড়াতে যাওয়ার কথা দিয়ে কি ভুল করেছি! আর ভুলইবা বলি কী করে? এই বয়সে তোমার মা-ও যে বেড়ানোর জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে, বুঝব কী করে?’ রিমি অভিমানী মুখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। 
এ অবস্থায় পলাশ যে কী করবে, চিন্তা করতে থাকে। মাকে সাথে না নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। মাকে না বলবেইবা কী করে। কী করে সম্ভব ! 
এ মুহূর্তে পলাশের একটাই সমস্যা। কী করে ঠাণ্ডা করবে রিমিকে। অথচ মাকেও যাতে সাথে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টা চালাতে হবে। মাকে না নিয়ে যাবে কী করে! পলাশ জানে, এমনিতে মায়ের বেড়ানোর খুব শখ। ভ্রমণসংক্রান্ত নানা বইও রয়েছে মায়ের হেফাজতে। একটু সময় সুযোগ পেলেই মা বসে পড়ে ওই সব বইপত্র নিয়ে। পড়ে চলে এক মনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেলে একেক সময়। এই তো, ক’দিন আগে পলাশ দেখে, মায়ের চোখ বোজা। মার মুখে চাপা খুশির আলতো ছোঁয়া। পলাশ তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে থাকে পলক না-পড়া দৃষ্টিতে। মা ওই সময় হয়তো ভাসছে কল্পনার স্রোতে। বইয়ে পড়া একের পর এক ভ্রমণবৃত্তান্ত ভেসে উঠছে মায়ের চোখের সামনে। 
মায়ের এই বেড়াতে যাওয়ার নেশা পলাশ দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু এমন কপাল, বেড়ানোর সুযোগ জোটেনি। বাবা সংসার চালাতেই হিমশিম। আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না তেমন। বাবার অবর্তমানে মায়ের এই শখ মেটাবে কে? একমাত্র সন্তান হিসেবে পলাশ ছাড়া আর কে আছে? 
আর রিমিকে যতটা বোঝে, তাতে নিশ্চিত, এ অবস্থায় বেড়াতে না গেলে রিমি ঝামেলা বাঁধাবে। একবার যখন বেড়াতে যাওয়ার কথাটা তুলেছে, তখন কি আর ছেড়ে কথা বলবে? না গেলে প্রতিটি মুহূর্তে কথায় কথায় খোঁচা দেবে। আবার রিমিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যে মাকে সাথে নেওয়ার জন্য রাজি করাবে, তাও সম্ভব নয়। ভীষণ জেদী মেয়ে রিমি। গুমরে মরবে। খোঁচা মারা কথা শোনাবে। কিন্তু নিজের জেদ থেকে এক চুলও সরবে না। 
ফোন বেজে ওঠে এ সময়। নিচে নেমে ফোন ধরে রিমি। পলাশও নেমে আসে পিছু পিছু। রিমির কথাবর্তা শুনে পলাশ বুঝতে পারে, ফোনের ওপাশে মুনতাহা। ফোনে রিমি এখন বলছে, ‘নারে মুনতাহা, বেড়াতে যেতে পারছি না। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। নানা ঝামেলা।’ 
প্রায় সাথে সাথে পলাশ চলে আসে ফোনের কাছটিতে। রিমির কাছ থেকে প্রায় জোর করে কেড়ে নেয় ফোনের রিসিভার। তারপর খুব মোলায়েম গলায় বলে,‘মুনতাহা, রিমির কথা বাদ দাও তো। আমরা যাবো। টুকটাক যা অসুবিধে, মিটে যাবে। ও নিয়ে ভেবো না।’ 
টেলিফোনের এ দিকের কথাবার্তার কিছু কিছু মায়ের কানে যায়। টেলিফোন বেজে ওঠার সাথে সাথে মা চলে এসেছিলেন বারান্দা থেকে। মায়ের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। কী হলো আবার! একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে বৌমার দিকে। 
ফোনে মুনতাহার সাথে পলাশের কথা শেষ হয়। মা তীব্র উৎকণ্ঠায় রিমিকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিগো বৌমা, বেড়াতে যাবে না কেন ? কী হলো ?’ 
অবস্থা বেগতিক বুঝে নিজের থেকে এগিয়ে আসে পলাশ। সামাল দেয় কোনোরকমে। মাকে বলে,‘ও আপনি বুঝবেন না। এমন কিছু নয়, মিটে যাবে।’ 
মা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। রিমির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বুঝলে বৌমা, পাঁচরকম ঝক্কিঝামেলা নিয়েই সংসার। তা নিয়ে এত ভাবলে চলে না। বরং আল্লাহর নাম করে বেরিয়ে পড়ি চল। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 
মা চলে যায় বাগানের দিকে। রিমি এগিয়ে আসে পলাশের একেবারে কাছটিতে। তারপর কানের কাছে মুখ এনে খুব চাপা অথচ রূঢ় গলায় বলে, ‘খুব তো বড় বড় কথা শোনালে। মুনতাহাকে শুনিয়ে দিলে বেড়াতে যাওয়ার কথা। আমি কিন্তু স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, মাকে সাথে নিলে আমি যাবো না। কিছুতেই না।’ 
রিমি পলাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আগুন দৃষ্টিতে। বেশ কিছু সময়। তারপর হনহন করে উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে। 
পলাশ কী উত্তর দেবে, খুঁজে পায় না। চুপচাপ। দৃষ্টিতে অসহায়তার ছায়া।
চার.
সকাল দশটা। ডাক্তার ইসলামের চেম্বার। ডাক্তার শরিফুল ইসলাম। অনেক সময় ধরে চেক-আপ করে চলেছে মাকে। ইসিজি করেছে মায়ের। ডাক্তারের অনুমান, হার্টের অবস্থা নাকি খুব একটা ভালো নয়। তাই, এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পর্দার ওপারে একটা বেডে মাকে শুইয়ে দিয়ে ইসিজি করছে ডাক্তার। পর্দার এপারে ডাক্তারের টেবিলের উল্টোদিকে বসে আছে মুনতাহা। রিমি আর পলাশ। রিমি আজ খুব চনমনে। চোখমুখ খুশি খুশি ভাব। মুনতাহার সাথে নিচু গলায় বকবক করে চলেছে সেই কখন থেকে। কথা আর ফুরায় না। 
পলাশের মুখ নিচু। পাংশুটে। চুপচাপ বসে রয়েছে এক পাশে। কিছুটা যেন আনমনা। রিমি আর মুনতাহার কথাবার্তায় কান নেই এতটুকু। 
চেক-আপ শেষ হয় মায়ের। মা এসে বসে ডাক্তার সাহেবের মুখোমুখি। ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে হাতখানেক দূরের একটা চেয়ারে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সাহেবের কপালে ফুটে ওঠে চিন্তার ভাঁজ। মুখ তুলে পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শুনুন, যা অনুমান করেছিলাম, ঠিক তাই। হার্টের যা অবস্থা, বেড রেস্ট চাই। টানা রেস্ট। সাথে চিকিৎসা।’
ডাক্তারের কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে মা, ‘কী বলছেন ডাক্তার সাহেব ! আর ক’দিন বাদে যে বেড়াতে বেরোব! বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি।’ 
‘পাগল হয়েছেন? এ অবস্থায় কেউ পাহাড়ে বেড়াতে যায়? ওসব এখন ছাড়–ন। হার্টের যা অবস্থা, কিছু একটা হয়ে গেলে!’
মা কিন্তু কিছুতেই হাল ছাড়েন না। পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘যা হয় হবে। কী আছে! তবে আমি বলছি, কিচ্ছু হবে না।’ 
‘এ কী বলছেন মা!’ ক্ষোভ মনে পুষে রেখে রিমি চোখমুখে ফুটিয়ে তোলে তীব্র উদ্বেগ।
ডাক্তার সাহেব তখন খুব শান্ত গলায় পলাশকে বোঝাতে যাচ্ছে, ‘শুধু ইসিজি রিপোর্ট খারাপ নয়, প্রেসারও হাই। এ অবস্থায় কোনো ঝুঁকি নেবেন না। তবে আমি একটা সুরাহা করতে পারি। আমার নার্সিংহোমে আপনার মাকে ভর্তি করে নিতে পারি। নিশ্চিন্তে রেখে যেতে পারেন। সব দায় আমার।’
পাঁচ.
তখন দুপুর। মা বিছানায় শুয়ে। চোখ দুটি বোজা। শুয়ে থাকতে থাকতে নানা ভাবনা ভিড় করে আসে মনের অলিন্দে। দেখতে দেখতে বয়স হলো। এখন পঞ্চান্ন। পলাশের বাবা হুট করে চলে গেল ফাঁকি দিয়ে। মারা গেল বাস অ্যাক্সিডেন্টে। তা আজ প্রায় কুড়ি বছর। তখন থেকে চোখের সামনে ছিল একটাই লক্ষ্য। পলাশকে মানুষ করে তোলা। সাফল্যও এসেছে কাজে। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি শরীরের কিছু কলকব্জায় মরিচা ধরে, ক্ষতি কী! তবে একটা ব্যাপার কিছুতেই ঢুকছে না মাথায়। অসুখ-বিসুখের তেমন কোনো লক্ষণ নেই শরীরে। অথচ হার্টের অবস্থা নাকি খারাপ। কী করে এমন হয়! এখনো তাহলে খাটাখাটুনি শরীরে সয় কী করে! চুপচাপ বসে থাকতে একেবারেই ভালো লাগে না। অবসর কাটে বইপত্র পড়ে। বিশেষ করে ভ্রমণবিষয়ক বই। আর বাকি সময়টা কাটে সংসারের নানা টুকিটাকিতে। এই হয়তো বাগানের কাজে। তো পরক্ষণে ব্যস্ত ঘরদোর গোছানোতে। তবে অসুখ-বিসুখ শরীরের ভেতরের ব্যাপার। শরীরের ভেতরে কোন অসুখ বাসা বাঁধছে, বাইরে থেকে তা বোঝা যাবে কী করে !
তখন ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া সারছিল রিমি, মুনতাহা আর পলাশ। রিমি আর মুনতাহা গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে। পলাশ নির্বাক। মুখখানা শুকনো। 
মা পাশের রুমে বিছানায় শুয়ে। শুয়ে শুয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন ডাইনিং রুমের প্রত্যেককে। তবে বুঁদ হয়েছিলেন নিজস্ব ভাবনায়। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কোন সময় তন্দ্রা এসে গিয়েছিল, খেয়াল নেই। তন্দ্রা কেটে যায় আচমকা। রিমি জোরে হেসে ওঠে।
হাসি থামিয়ে মুনতাহা এখন বলছে, ‘রিমি, ঝামেলাটা কেমন মিটিয়ে ফেললাম দেখলি তো। ওই ডাক্তার ইসলাম আমার এক সময়ের ক্লাসমেট। আর আমার কথা শুনবে না? শোন, আগে থেকে আমার সব কথা বলাই ছিল। তাই তো, ইসিজি রিপোর্টটার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছে। ভুলভাল রিপোর্ট দিয়েছে। স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম, রিমির শাশুড়িকে ভয়টা না দেখালে বেড়াতে যাওয়া আটকাব কী করে! কী রে! এবার খুশি তো !’
মা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠিক শুনছে তো ! পলাশ নির্বাক। রিমির মুখে খুশির আঁচ। মা শুধু চমকে যায় না, এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তছনছ হতে থাকে ভেতরটা। কুঁকড়ে যায় লজ্জায়। মুখ লুকোতে চায় অন্ধকারে। ঘামতে থাকে দরদর করে। কাঁপতে থাকে ঠোঁট দুটো। করকর করে ওঠে দু’চাখে। অথচ কেঁদে উঠতে পারে না। ভয় হয়। বড় ভয়। ভালোবাসাহীন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ভয়।

Comments