বিড়ম্বনা
মুসফিরা মারিয়াম
মাঝে মধ্যে পূর্ণিমা রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। নাম ঠিকানা পরিচয় কিছুই থাকবে না। কেউ যদি বলে- আপনার নাম কি ভাই?
-জানি না।
-পরিচয় কি?
-মানুষ।
- বাড়ি কোথায়, মানে ঠিকানা কি?
-পুরো বিশ্বই আমার ঠিকানা।
জীবনটা এমন হয়ে গেলে কেমন হয়। জনগণ রাস্তা ঘাটে রামধোলাই দেবে না তো আবার! নাহ এত সাহস তার নেই। কিন্তু মাঝে মধ্যে জগৎ সংসার ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চায়। হয়তো কখনো সত্যি সত্যি বেরিয়েই পড়বেন। গভীর ধ্যানমগ্ন জহির সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান শোনা যাবে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। জহির সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। নাক ডাকার সাইরেন তখনো বেজেই চলছে. . . . . . . . . . . . . . . .
মুসফিরা মারিয়াম
****************
জহির সাহেব রাত ১২টা থেকে বসে আছেন। সামনে টেবিলে রাখা এ ফোর সাইজের কিছু কাগজ পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া, সেসাথে নীল ফুল তোলা সুন্দর একটি কলম। তার ভ্রু দু’টি সামান্য কুঁচকে আছে। যেন তিনি কারো ওপর ভীষণ রেগে আছেন। হাতের ডানপাশের বেডে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে স্ত্রী আফরোজা বেগম। বাব্বাহ, কোনো মানুষ কি করে এত জোরে নাক ডাকতে পারে, সাইরেনের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ হচ্ছে। এটাও তার রাগের একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হলো জহির সাহেবের ভেতর রাগ নামক কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই। তিনি কখনোই কারোর ওপর রাগ করতেই পারেন না। আর যদি কখনো রেগেও যান তাহলে কথা বলতে পারেন না। পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। যার সাথে রাগ করতে চান, সেই বরং দয়া দেখিয়ে বাসায় এনে দিয়ে যায়। এরপর তার ওপর আর কোনো রাগ থাকে না। বরং মায়া হয় সেই লোকটির জন্য। অফিসের কলিগরাও তাকে দেখলে হাসি-ঠাট্টা থামিয়ে দেয়। যেন তিনি ভিনগ্রহ থেকে নেমে আসা কোনো প্রাণী, হাসি ঠাট্টায় যোগ দেয়ার কোনো অধিকারই তার নেই। অফিসে তার সিনিয়রা তার সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন, তিনি বৃদ্ধ বা মুরুব্বি শ্রেণীর কেউ। চল্লিশোর্ধ জহির সাহেবের মাথায় আসে না সবাই কেন তার সাথে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করে। আশ্চর্য, তার কি হাসি-আনন্দে যোগ দেয়ার কোনো অধিকার নেই! পাশের টেবিলে তারই বয়েসী মতিন সাহেব যখন সুদর্শনা অপারেটর মেয়েটির সাথে হেসে হেসে কথা বলে, জহির সাহেবের গা-জ্বালা করে। নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে- ন্যাকা! শব্দটি মুখের ভেতরেই আটকা পড়ে যায়। লজ্জিত জহির সাহেব চারদিকে তাকিয়ে দেখেন কেউ শুনে ফেলল কি না। শুধু অফিসেই নয়, বাইরেও একই অবস্থা। আত্মীয়স্বজনদের জন্য তিনি এতটা করেও কারো মন পান না। আত্মীয়রাও তাকে কেমন যেন এড়িয়ে চলে। প্রতি মাসে তিনি একবার করে গ্রামে যান। কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ছেলের সুন্নত, সাধ্যমতো সাহায্য করেন দরিদ্র আত্মীয়স্বজনকে। অথচ কেউ তাকে বোঝে না। বিয়ের পর থেকেই তিনি দেখে এসেছেন শালা-শালীরা পর্যন্ত তার কাছে খুব একটা ঘেঁষতো না। কি এক অদৃশ্য কারণে যেন সবাই তাকে ভয় পায়, অথচ কোনো দিন কারো সাথে রাগ করেছেন বলে মনে পড়ে না। কখনো কারো কোনো ক্ষতি ও করেন না, কারো সাথে জোরে কথা পর্যন্ত বলেন না। তবু কেন সবাই তাকে ভয় পায়। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে কখন যে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে শার্টে পড়ল খেয়ালই করেননি। সামনে টিস্যু বক্সটাও নেই। তাড়াতাড়ি শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন তিনি। আফরোজা বেগম দেখে ফেললে সমস্যা আছে। চেঁচিয়ে বাড়িসুদ্ধ লোক জড়ো করে ফেলবে। শুধু তাই নয়, এ গল্পটা অফিস পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আফিসের কলিগদের ফ্যমিলিসহ দাওয়াত করলে হয়তো ইনিয়ে-বিনিয়ে এ কান্না নিয়ে বিশাল এক গল্পজুড়ে বসবে। ভাবী জানেন, ‘সেদিন না হঠাৎ, ঘুম থেকে জেগে দেখি ও হু হু করে কাঁদছে, সেকি কান্না। আসলে ওপরে ওপরে রাগী হলে কি হবে ভেতরটা ওর ভীষণ নরম।’
এ জাতীয় কোনো গল্প। ডিসগাস্টিং একটা ব্যাপার। বিয়ের পঁচিশ বছর হতে চলল, কিন্তু তার এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই। অদ্ভুত মাথামোটা একটি মহিলা। তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্দেহ। জহির সাহেব যেই গল্পই লিখবেন সেই গল্পের নায়িকাকেই তার প্রেমিকা বানিয়ে ফেলবে। বিয়ের প্রথম দিকে তো কেঁদে-কেটে একাকার করে ফেলত। তারপর সময়ের সাথে সন্দেহের রূপটা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সেটার শেষ হয়নি। এখনো কোনো গল্প লিখলে সেটা বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে। তারপর জহির সাহেবের সামনে এসে সেই পরিচিত আঞ্চলিক ভাষায় বলবে- ছেমরিডা কেডা? নায়িকা যদি মহিলা হয় তাহলে বলবে- বেডিডা কেডা? রেগে গেলে আফরোজা বেগম আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। জহির সাহেব ভেবে পান না তার কি রাগ করা উচিত! এই একই প্রশ্ন বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত তাকে একশ’ ছাব্বিশবার শুনতে হয়েছে। কারণ, বিয়ের পর থেকে তার লিখা গল্পের সংখ্যা একশ’ ছাব্বিশ। কিছুদিন আগে একটা গল্প লিখেছিল, গল্পটির মূল চরিত্রে ছিল নসিমন বিবি নামক এক কাজের বুয়া। সেদিন রাতভর কান্নাকাটির মহড়া চলল। পরদিন থেকে কাজের বুয়াকে আর বাসায় দেখা গেলো না। জহির সাহেবেরও আর কিছু বলার সাহস হলো না। বললে আবার না জানি কোনো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়। আফরোজা বেগমের কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেল। দু’দিন পর নিজের থেকেই মুখ খুললেন- ‘এই আছিল তুমার মনে? ছোডলোক। পারুলের চক্ষুর পানি তুমার মনে দরে, না! যাও পারুলরে লইয়া সংসার পাতো।’ সদ্য চাকরিচ্যুত কাজের বুয়াটির নাম ছিল পারুল। আফরোজা বেগমের ধারণা জহির সাহেব নসিমন বিবি ছদ্মনামে আসলে পারুল নামের মেয়েটিকে নিয়ে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, আফরোজা বেগমকে দজ্জাল গৃহকর্তী বানিয়ে ফেলেছেন। সারাদিন অফিস করে এসে এসব শোনার কোনো মুডই ছিল না তার। তবুও তাকে শুনতেই হয়। মাঝে মধ্যে পূর্ণিমা রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। নাম ঠিকানা পরিচয় কিছুই থাকবে না। কেউ যদি বলে- আপনার নাম কি ভাই?
-জানি না।
-পরিচয় কি?
-মানুষ।
- বাড়ি কোথায়, মানে ঠিকানা কি?
-পুরো বিশ্বই আমার ঠিকানা।
জীবনটা এমন হয়ে গেলে কেমন হয়। জনগণ রাস্তা ঘাটে রামধোলাই দেবে না তো আবার! নাহ এত সাহস তার নেই। কিন্তু মাঝে মধ্যে জগৎ সংসার ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চায়। হয়তো কখনো সত্যি সত্যি বেরিয়েই পড়বেন। গভীর ধ্যানমগ্ন জহির সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান শোনা যাবে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। জহির সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। নাক ডাকার সাইরেন তখনো বেজেই চলছে. . . . . . . . . . . . . . . .
Comments
Post a Comment