একটি ছেঁড়া কম্বল
আ হ মে দ উ ল্লা হ্
শীতের ভোরবেলা। সূর্যোদয় হতে বেশ সময় বাকি... প্রচণ্ড শীত পড়েছে, চার দিকে ঘন কুয়াশা। কুয়াশার ঘন আবরণে বেশি দূর দেখা যায় না। নীড়ে বসে বসে নীদভাঙা বিহগকুল ঊষার গীত গেয়ে গেয়ে নিশাবসানের জানান দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাসা ছেড়ে বের হচ্ছে না শৈত্যের তীব্রতায়।
বিহগের প্রভাত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে ভোরের পৃথিবী জেগে উঠছে আড়মোড়া ভেঙে। মানুষের ঘুম ভাঙলেও, কম্বলের ওম ছড়ানো বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় না কেউ।
কেউ না উঠলেও লিলু মিয়াকে উঠতে হয়েছে ঠিকই। না উঠে কোনো উপায় নেই তার। ওম জড়ানো বিছানায় শুয়ে থাকলে কি আর অন্নের আয়োজন হবে?
শিশিরঝরা সকালে মাছ ধরার জন্য বের হতে হয়েছে লিলু মিয়াকে। শীত যেন তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে। গায়ের পুরনো চাদরটি জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে নদীতীরে এসে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। শীতে জড়সড় হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে- জলশূন্য তিতাস নদীর দিকে।
নদীতে পানি নেই, জাল ফেলবে কোথায়! যেখানে জল নেই, সেখানে জাল ফেললেই বা কী হবে! মাছ পাবে? জল বিনে মাছের আশা করা যায় না। অথচ সেই ছোট্টবেলা থেকেই এই নদীর মাছ বিক্রি করেই সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে লিলু মিয়া। আজ নদীটি মরা নদীতে রূপ নিয়েছে।
পৌষের শুরু থেকেই নদীর পানি একেবারে শুকিয়ে যায়। স্বচ্ছসলিলবাহী তিতাস পরিণত হয় আবাদি জমিতে। পয়স্তি অনুসারে যে যার মতো দখল করে, রোপণ করে বোরো ধান। দেখে মনে হয়- নদী তো নয়, যেন ফসলের ময়দান।
এক যুগ আগেও নদীটির এমন করুণ অবস্থা ছিল না। দুকূল উপচে প্রবাহিত হতো জলরাশি। ঝুমকা পরা নৃত্যরত কুমারীর মতো নেচে নেচে মেতে উঠত উৎফুল্ল তিতাসের ঢেউ খেলানো জলরাশি।
শুকনো নদীতীর ধরে হেঁটে হেঁটে হেরুন মিয়ার বাড়ি বরাবর এসে দাঁড়ায় লিলু মিয়া। নদীতীর ঘেঁষেই হেরুন মিয়ার বাড়িটি। বাড়ির সামনে নদী কিছুটা গভীর থাকায়, এখানে যৎসামান্য পানি জমে থাকে। কথায় বলে, ‘খায় ঘাটের পানি শুকায় না’। এ কথাকে বাস্তবে রূপ দিতেই বোধ হয়- এখানে সামান্য পানি জমে থাকে সারা বছর।
পাড়ার লোকজন এখানে এসে স্নান করে, চাল-সবজি ধৌত করে এবং রান্নাবান্নার জন্য কুলবধূরা পানি নেয় বাড়িতে। এ কারণেই হয়তোবা পুরো নদী শুকিয়ে গেলেও এই জায়গাটুকু শুকায় না।
লিলু মিয়া দাঁড়িয়ে ভাবছে- এখানে জাল ফেলা যায় কি না! সামান্য পানিতে যদিও মাছ থাকার সম্ভাবনা একেবারেই কম, তবুও মনের আশা নিবৃত্ত হচ্ছে না। আশা হারালে চলবে না। যেভাবেই হোক, যেখান থেকেই হোক তাকে মাছ ধরতেই হবে। মাছ না ধরলে, বাজারে নিয়ে বিক্রি করবে কী? বাজারে মাছ বিক্রি করে চাল কিনে বাড়িতে নিতে না পারলে, খাবে কী, বউ-বাচ্চাদের খাওয়াবে কী?
গত রাতে খাওয়ার সময় ছোট্ট মেয়ে রূপসী বাবার পাশে এসে বলেছিল, ‘বাজান, ও বাজান, এমন ঠাণ্ডা আর শীত পড়ছে- ইস্কুলে যামু ক্যামনে! ঘরের মধ্যেও শীত সহ্য হয় না।’
‘সহ্য না হইলে আর কী করবি, খেতা গতর দিয়্যা ঘরেই শুইয়্যা থাকবি।’ মুখ বাঁকিয়ে লিলু মিয়া বলল। আরো কাছে এসে গা ঘেঁষে বসে রূপসী বলে, ‘আমারে একটা সোয়েটার কিইন্যা দ্যাও না বাজান! শীত যে আর সহ্য হয় না। মার ছিঁড়া কম্বলটা আমি গায়ে দিলে, মার কষ্ট হয় না!’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিলু মিয়া বলে, ‘তর মা এহন বুড়া হইয়্যা গেছে, তার আর তেমন শীত লাগে না।’
স্বামীর প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে লিলু মিয়ার স্ত্রী বানেছা বলে, ‘বুড়া হইলে, শীত আরো বেশি লাগে। তুমি কী জানো না, এমন বয়সে শরীলের রক্ত কইম্যা যায়, তাই ঠাণ্ডা বেশি লাগে।’
বাঁকা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে লিলু মিয়া বলে, ‘বেশি ঠাণ্ডা লাগলে, আগুন পোহাবি। দেখবি, ঠাণ্ডা কই গিয়্যা পলায়।’
‘এইবার যেই শীত পড়ছে- না জানি কে মরে, কে জানে!’
কিছুটা ধমকের স্বরে লিলু মিয়া বলে, ‘বিপদ ডাইক্যা আনিস না। শীতে কি আর মানুষ মরে নাকি!’
‘তোমার কী মনে নাই- গত বছর মাঘের শীতে কেমন কষ্ট পাইতে পাইতে উত্তর পাড়ার ফুলমালায় মইর্যা গেছে।’
স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে লিলু মিয়া বলে, ‘হ, তুই তো ঠিকই কইছত। ফুলমালায় তো এমন শীতেই মরছিল। ডাক্টার আইস্যা কইছিল- শীত আর ঠাণ্ডায় শরীলের রক্ত নাকি জইম্যা গেছিল।’
ফুলমালার জীবনটাই ছিল কষ্টের বন্দরে নোঙর করা। মধ্য বয়সেই স্বামীহারা হয়ে, বাপের বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। না এসেই বা কী করবে! তার না ছিল সন্তানসন্ততি, না ছিল স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি। বিয়ের পর, বাপের বাড়িতে ফিরে আসার যন্ত্রণা, স্বামীহারা যন্ত্রণার চেয়েও কম নয়।
মৃত্যুর আগে ফুলমালার বাপ তাকে পুনরায় বিয়ে দেয়ার চেষ্টাও কম করে যায়নি, কিন্তু পারেনি। একসময় এসে তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়। তখন আর যাবেই বা কোথায়! ভাই-ভাবীদের অবহেলা ও কটূক্তি সহ্য করেই থাকতে হয়েছে জীবনভর। মানুষের বাড়িতে পেটেভাতে কাজ করে জীবন চালিয়েছে। কোনোমতে খাদ্যের ব্যবস্থা হলেই হয়, আর কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না তার জীবনে। এভাবে চলতে চলতেই বার্ধক্যের কালোছায়া কাল হয়ে দেহ জড়িয়ে ধরে- যাতনার কাঁটা বিঁধিয়ে। দেহ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে একসময়।
বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর, তার জীবনে নেমে আসে বাঁধভাঙা যাতনার যাঁতাকল। প্রতিবেশীদের দয়ার ওপর জীবন কাটে খেয়ে না খেয়ে। ঠিকমতো খাবার ও কাপড় মেলেনি জীবনের শেষ কয়েকটি বছর।
সেবার শীত জেঁকে বসেছিল প্রকৃতির ওপর। ফুলমালার কষ্টের খবর কেউ নেয়নি। ভাই-ভাবীদের দৃষ্টি কেবল- জমদূতের দিকে; কখন তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কেউ বিরক্তির স্বরে এ কথাও বলেছে যে, ‘জমদূত কি ফুলমালারে দেখে না, তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে, এমন কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় না কেন!’
পুরনো তালি দেয়া কম্বলে তার শীত মানে না। পুরনো এ কম্বলটি কয়েক বছর আগে তাকে দিয়েছিল, পূর্ব পাড়ার প্রবাসফেরত ব্যবসায়ী অলি আহাম্মদ সাহেব। অলি আহাম্মদ গ্রামের একজন দয়ালু ব্যক্তি। প্রতি বছর শীতের সময় গ্রামে এসে গরিব-দুঃখী মানুষকে নিজ হাতে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
এই কম্বলটি বেশ যত্নের সাথে এতটা বছর গায়ে দিয়ে শীতের সাথে যুদ্ধ করে এসেছে ফুলমালা। মাঝে মাঝে ছিদ্র হয়ে গেছে, কিন্তু তালি দেয়ার শক্তিটুকুও তার গায়ে আর নেই। এটিই কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে রাখে শীত প্রতিরোধে।
এখন আর আগের মতো হেঁটে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে কিছু চেয়ে আনার শক্তি নেই। শীতে কেঁপে কেঁপে প্রতিবেশীদের ডাকলেও, কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। অনেকেই হাস্যরস্য করে, কেউবা বিরক্তিকর শব্দে উড়িয়ে দেয়- তার হাউমাউ আর্তচিৎকার!
সেদিন ভোরে ফুলমালার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে, প্রতিবেশীরা ভাঙা-বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পায়- মাটিতে বিছানো খড়ের ওপর নিঃশব্দে পড়ে আছে ফুলমালার প্রাণহীন দেহ। ছেঁড়া কম্বলটি এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে আছে গায়ের ওপর। ভাঙা দরোজা খুলে ঘরে গিয়ে দেখতে পায়- শরীর শক্ত হয়ে আছে।
গ্রাম্য ডাক্তার ডেকে আনা হলে, তার মৃত্যুর নিশ্চয়তার মৌখিক সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় ডাক্তার। অতিরিক্ত শীতের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলেই ডাক্তার জানিয়ে দেয়।
এ কথা মনে পড়ায়, লিলু মিয়া আৎকে উঠে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘কাইল মাছ বেইচ্যা যা টেকা পামু, সব দিয়্যা শীতের কাপড় কিইন্যা আনমু। একদিন না খাইলেও মানুষ মরে না। কিন্তু ঠাণ্ডা আর শীত মানুষের জীবন কাইড়্যা নিতে পারে।’
আগামীকাল বাবা শীতের কাপড় আনবে শুনে খুশিতে নেচে উঠে রূপসী বলে, ‘মার লাইগ্যাও কিন্তু আনতে হইব, মার পুরনো কম্বলটা এক্কেবারে ছিঁইড়্যা গেছে।’
মুচকি হেসে লিলু মিয়া বলে, ‘আনমু, সবার লাইগ্যাই আনমু মা।’
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর জাল ফেলতে শুরু করে পানিতে। কয়েকবার জাল ফেলে, টেনে তোলার পর- শামুক-ঝিনুক ব্যতীত মাছের চিহ্নও দেখা গেল না।
ঠাণ্ডাপানির স্পর্শে তার শরীরের কাঁপন আরো বেড়ে গেছে। গায়ের চাদরটি ঠিকমতো জড়িয়ে জাল ছেড়ে তীরে এসে দাঁড়ায়। লুঙ্গির গোছা থেকে বিড়ির প্যাকেটটি বের করে, একটিতে আগুন ধরিয়ে বেদুম টানছে জড়সড় হয়ে তীরে দাঁড়িয়ে।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, জালটিকে গুছিয়ে ভাবছে- মেয়েটিকে কথা দিয়েছে- আজ যে-করেই হোক না কেন, তার জন্য শীতের কাপড় নিয়ে যাবে। যেভাবে শীত জেঁকে বসেছে, না নিয়ে কোনো উপায় নেই। জালটি কাঁধে চাপিয়ে বিলের দিকে হেঁটে চলছে লিলু মিয়া চৌধুরী। যদি মিলে যায় কিছু মাছ।
Comments
Post a Comment