বাংলাদেশের মোহাম্মাদ আলী ক্লে
বাংলাদেশ আর মোহাম্মদ আলীর মধ্যে দুর্দান্ত একটা মিল আছে। সেটা হলো বিদ্রোহ। সেই অনাদিকাল থেকে বাংলা মানেই বিদ্রোহ। আর্যদের আধিপত্যই হোক, কিংবা আফগান, মোগলদের শাসনই হোক, বাংলার জমিন যেন সবসময়ই সবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসত।
১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েড বক্সিংয়ে সোনা জয়ের মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ আলী খ্যাতি অর্জন করেন। এর পর পরই পেশাদার মুষ্টিযুদ্ধে চলে যান আলী। ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ বলে খ্যাত এই মুষ্টিযোদ্ধা ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে মার্কিন মুষ্টিযোদ্ধা সনি লিস্টনকে হারিয়ে হেভিওয়েড চ্যাম্পিয়ন হন। প্রথম মার্কিন কোনো মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে তিনবার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন আলী। ৬১টি মুষ্টিযুদ্ধের ৫৬টিতেই জয় পান তিনি, এর মধ্যে ৩৭টিই ছিল নক আউট (প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী)। ১৯৮১ সালে অবসর নেন মোহাম্মদ আলী। রিংয়ের বাইরে কথাবার্তা, খেলায় ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা এবং অনন্য ক্রীড়াশৈলীর জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি।
আর মোহাম্মদ আলী ছিলেন আরেক বিদ্রোহী। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, পাশ্চাত্য আগ্রাসন, খ্রিষ্টীয় প্রাধান্য সবকিছুর বিরুদ্ধেই তিনি লড়াই করেছেন। আর এ কারণেই তিনি যখন বাংলাদেশে আসার ডাক পেলেন, তখন না এসে পারেননি। আর এসেই মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশ হলো তার কাছে বেহেশতের একটি টুকরা। একদিন হয়তো স্থায়ীভাবেই এখানে বাস করবেন। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশকে তিনি যেমন ভালোবেসেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষও তাকে আপন করে নিয়েছিল। বাংলাদেশে তার এক খণ্ড জমিও ছিল। বাংলাদেশের মানুষ তাকে বাংলাদেশীই ভাবত। এ কারণেই তার ইন্তেকালে প্রতিটি বাংলাদেশী শোকে বিহ্বল হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে এসেছিলেন মোহাম্মদ আলী। কেবল ঢাকায় থাকেননি, গিয়েছেন সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান, পাহাড়ি শহর রাঙ্গামাটি এবং দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।আলীর ওই সফরটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র সাত বছর। ফলে ওই মাপের এক কিংবদন্তির বাংলাদেশ সফর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নতুন মাত্রা লাভ করে।
তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে এসেছিলেন মোহাম্মদ আলী। কেবল ঢাকায় থাকেননি, গিয়েছেন সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান, পাহাড়ি শহর রাঙ্গামাটি এবং দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।আলীর ওই সফরটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র সাত বছর। ফলে ওই মাপের এক কিংবদন্তির বাংলাদেশ সফর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নতুন মাত্রা লাভ করে।

সফরের একপর্যায়ে মোহাম্মদ আলীর হাতে নাগরিকত্বের সনদ তুলে দেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
এই সম্মানে অভিভূত হয়েছিলেন কিংবদন্তির আলী। তিনি বলেছিলেন, এই দেশকে তিনি মনে করেন বেহেশত। জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্র তাড়িয়ে দিলে এ দেশেই আশ্রয় নেবেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী যখন কক্সবাজার সফরে যান তখন তাকে সংবর্ধনা দেয় জেলাবাসী। ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই এই বক্সিং গ্রেটকে কলাতলীতে একখণ্ড জমি উপহার দেয়া হয়। আর তা দেন কক্সবাজার জেলার তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আখতার নেওয়াজ খান বাবুল। তখন জমির কাগজপত্রও মোহাম্মদ আলীর হাতে তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সফরে অনেক স্মৃতি রেখে যান এই বক্সিং গ্রেট। তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) দক্ষিণে পল্টন ময়দানের একপ্রান্তে নিজের নামে একটি মুষ্টিযুদ্ধ স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন। এটি নির্মাণের জন্য অর্থায়নও করে যান। তবে মোহাম্মদ আলী স্টেডিয়াম নামের এই স্থাপনাটি এখনো টিকে থাকলেও সেদিনকার উদ্বোধন ফলকটি আর নেই। ওই সময় তিনি ঢাকা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ১২ বছরের কিশোর মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে বক্সিং ম্যাচও খেলেন। আর ওই ম্যাচে হেরে যান মোহাম্মদ আলী। হাজার হাজর দর্শক উপভোগ করেছিলেন ওই ম্যাচটি, যা এখনো স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায় সেদিনকার সেই ১২ বছরের কিশোর মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের। তার কাছে মোহাম্মদ আলী ছিলেন স্বপ্নপুরুষ। কিংবদন্তি এই বক্সারের সাথে গিয়াসউদ্দিনের প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হলেও মোহাম্মদ আলীর বাহুতলে গিয়ে নিজেকে সার্থক মনে করেছেন ‘বাংলার আলী’ খ্যাত আবদুল হালিম। তার কাছে মোহাম্মদ আলী মানেই ছিলেন প্রাণপুরুষ। তাই তো আবদুল হালিম ও গিয়াসউদ্দিনের স্মৃতিতে আজো অম্লান মুষ্টিযোদ্ধার সর্বকালের সেরা মোহাম্মদ আলী। ঢাকা সফরে যদিও প্রথমে মোহাম্মদ আলীর লড়াই কথা ছিল ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’ খ্যাত আবদুল হালিমের। কিন্তু তখন মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন সত্যিকারের লড়াই করার মতো মানসিকতা তার নেই। শুধু ‘ফান বক্সিং’ করবেন। আর তখনই বক্সিং ফেডারেশন বাসাবোর ছেলে ১২ বছরের কিশোর গিয়াসউদ্দিনকে লড়াইয়ের জন্য নির্বাচিত করে। মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুর দিন তাকে নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে গিয়াসউদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না যে, গ্রেট মোহাম্মদ আলীর সাথে লড়ব। তবে আমি দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে রিংয়ে নেমে পড়েছিলাম।’
স্মৃতি হাতড়ে গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘এমন মানুষের সান্নিধ্যের দিনক্ষণ কখনোই ভোলা যায় না। ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পা রাখার পরই মোহাম্মদ আলী চলে যান সিলেট চা বাগান পরিদর্শনে। পরদিন তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) মাঝখানে স্টেজ করে বক্সিং রিং বসানো হয়। সুবিশাল পরিসরে সেখানেই এই বক্সিং গ্রেটকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। এর পরই পল্টনস্থ মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন তিনি। আর প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হয় তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে বসানো বক্সিং রিংয়েই। কিন্তু মোহাম্মদ আলী বড় নয়, ছোট একজন বক্সারকে খুঁজছিলেন প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য। যেখানে আমি নির্বাচন হই।’ গিয়াসউদ্দিন আরো বলেন, ‘সেই প্রদর্শনী ম্যাচের কথা আজো আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। একটি বাউটের খেলা হয়। যেখানে তিন মিনিট করে তিন রাউন্ড ও এক মিনিট করে তিন রাউন্ডের খেলা হয়েছিল। মাঝে তিন মিনিটের বিরতিও ছিল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বক্সার। তার বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে আমার হাত-পা যেন কাঁপছিল। কিন্তু তিনিই আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। আমার প্রত্যেকটি ঘুষিতেই তিনি পড়ে যাওয়ার ভান করছিলেন। সবাই ভেবেছে আমিই নকআউট করে দিচ্ছিলাম মোহাম্মদ আলীকে। আমি দেখেছিলাম তার বাম গালে একটা কাটা দাগ, তিনি আমাকে মুখে মারতে মানা করেছিলেন। যদিও দীর্ঘদেহী মোহাম্মদ আলীর মুখে মারার মতো দীর্ঘ হাত আমার ছিল না। আমি তার বুকে- পেটে মারার চেষ্টা করেছিলাম। সেই সময়ের কথা বলে বোঝানো যাবে না। কতটা আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর ভালোলাগা আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। আজ যখন তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তখন খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। একজন আইডলকে হারিয়েছি আমরা।’
১৯৬৮ থেকে ’৮০ সাল পর্যন্ত দেশের বক্সিংয়ে সেরা সময় কাটিয়েছেন আবদুল হালিম। যাকে বাংলার আলীও বলা হতো। ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির কথা স্মৃতির ঝাপি থেকে খুললেন হালিম, ‘ছয় ফুট তিন ইঞ্চির মোহাম্মদ আলীর সামনে যেন আমি খুদে (৫ ফুট ২ ইঞ্চি) মানুষ ছিলাম। তারপরও তার সাথে আমারই ফাইট করার কথা ছিল। কিন্তু ছোট ছেলের সাথে ফাইট করার কথা জানান মোহাম্মদ আলী। ফলে সুযোগটি পেয়ে যায় গিয়াসউদ্দিন। দর্শকের ভিড় ঠেলে যখন আমি তাকে বললাম, আমি আপনার সাথে ছবি তুলতে চাই। তখন আমার মুখের সামনে ঘুষি মারতে উদ্যত হন। সেই ছবি আজো আমার কাছে প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে রয়েছে। আজো আমি সেদিনের কথা ভুলতে পারিনি।’বাংলাদেশ সফরে মোহাম্মদ আলীকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। ওই সফরেই তাকে দেয়া হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেয়া নাগরিকত্ব পেয়ে ওই অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাকে যদি কখনো আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, তবে ভাবব আরেকটি দেশ আছে আমার, সেটি বাংলাদেশ।’বাংলাদেশের যেখানেই গেছেন সেখানেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী। যে কারণে তখন তিনি বারবার বলেছেন, আবার ফিরবেন এই সবুজ বাংলায়। কিন্তু না, তার আর ফেরা হয়নি। তার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
Comments
Post a Comment