ফেরা -- সাঈদ আজাদ

ফেরা
-- সাঈদ আজাদ 

শুয়ে ছিলেন। কাশতে কাশতে বিছানায় ওঠে বসেন সিদ্দীক। কাশির দমকে ফুসফুস যেন বের হয়ে আসতে চায়। রাত কত হল কে জানে! তবে বেশি হওয়ার কথা না। গ্রাম এখনও নিঝুম হয়নি। মাঝে মধ্যে লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। অবশ্য গ্রাম আর এখন আগের গ্রাম নেই যে সাঁঝ হতে না হতেই পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়বে। এখন গ্রামের লোকজনও মধ্যরাতের আগে ঘুমায় না। ঘরে ঘরে ডিসের কানেকশন। হিন্দি সিনেমা কী ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়াল কোনোটাই বাদ যায় না। এইতো, এখনও পরিচিত এক সিরিয়ালের বাজনা শোনা যাচ্ছে। নিজে না দেখলে কী হবে, তার বাসায়তো কোনো সিরিয়াল দেখা বাদ যেতে দেখেননি।
গ্রামে আগে আসতেন মাস না যেতেই। বহুদিন আসেন না। এখন আসবেন কার কাছে! মা নেই বাপ নেই। আদরের বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইরাও নিজেদের নিয়ে মহাব্যস্ত। তাছাড়া নিজেরওতো সংসার আছে। কমতে কমতে আসা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। ভাইরাও তেমন করে আসার কথা বলত না। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে মনই টিকত না তার। লোকজন বলে বটে, ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য। জ্যাম ভিড় শব্দ। নানা দূষণ। ভুল যে বলে তা নয়। তবে বলতে কী, এ ভিড় আর শব্দে একদিন না থাকলে যেন মন কেমন করে তার। তাই যেখানেই যান রাতের আগে ফিরে যান। ঢাকা শহরের আলো শব্দ ভিড়কেই ভারি আপন মনে হয়।
গত এগারো বছর আসা হয়নি গ্রামে। সাতষট্টি বছর বয়সে বাড়ি ফিরে বেশ অবাকই হয়েছেন সিদ্দীক। সব কেমন পাল্টে গেছে! সন্ধ্যা না হতেই ঘরে ঘরে, উঠানে আলো জ্বলে উঠছে। টিভিতো চলছে সারা দিনই। টিনের বাড়ি নেই-ই বলতে গেলে। পাকা দালান সব। দোতলা তিনতলাও আছে। বাড়ির একেবারে পাশ ঘেঁষে পাকা রাস্তা চলে গেছে। কী সুন্দর সিএনজিতে তাকে একেবারে উঠানে নামিয়ে দিয়ে গেল। বোঝা যায় দ্রুতই বদলেছে গ্রাম।
লেপ ছেড়ে ওঠে সুইচ টিপে লাইট জ্বালেন সিদ্দীক। পয়সা জগে টিউবওয়েলের পানি রেখে গেছে। একটু পানি খেলেন। পানি বরফ শীতল। মুখের ভেতরটা যেন বরফ হয়ে গেল। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। গ্রামে এত শীত ভাবতেও পারেনি। এতদিন ঢাকায় ছিলেন। কবছর ধরেতো শীত কী টেরই পেতেন না। ছোটবেলা কত শুনেছেন মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে। ঢাকায় থাকতে থাকতে প্রবাদটা ভুলেই গেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে প্রবাদটা যথার্থ। মাঘ মাস শুরু হয়েছে কেবল। আজ মনে হয় তিন তারিখ। শীতে হাত-পা যেন বাঁকা হয়ে আসছে। আচ্ছা, এমনকি হতে পারে বয়সের কারণে তার শীতটা বেশি লাগছে?
গলা খাঁকারির শব্দ শোনা যায় উঠানে। বোধহয় পয়সা। কে? পয়সা নাকি?
দরজাটা খোলেন।
সিদ্দীক দরজা খুলে বের হয়ে উঠানে গিয়ে দাঁড়ান।
পয়সা ঘরে ঢোকে। বাইরে কুয়াশা পড়ছে, আপনি ঘরে এসে শোন। আমি সরিষার তেল আর রসুন গরম করে আনি। বুকে মালিশ করে দেব।
এতরাতে আবার চুলা জ্বালাবি? দরকার নেই। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই চলে যাবে কাশি। তোরওতো ঘুমের সময়।
আমার জন্য ভাববেন না অত। কাজ নাই কাম নাই। দিনে ঘুমাইতে পারব। কাশির শব্দ আমার ঘর থাইক্যা শোনা যাইতাছিল। পয়সা রান্নাঘরে ঢুকে আগুন জ্বালে। আগুনে উঠান আলোকিত হয়ে ওঠে।
ছোট বাটিতে পয়সা রসুন আর সরিষার তেল নিয়ে বিছানার ধারে বসে। ধীরে ধীরে মালিশ করে বুকে। গরম তেলে বেশ আরাম লাগে। শীতটাও যেন কমে একটু।
হয়েছে। আর ডলা লাগবে না। তুই এখন যা। অনেক কষ্ট করলি।
রাতের খানা খাইছিলেননি?
খাব আমি। তুই যা। রাতে বিরাতে হুট হাট আসিস, লোকে কী ভাববে!
হ লোকের আর খাইয়্যা দাইয়্যা কাম নাই। আমারে নিয়া ভাবব! জোয়ান বয়সের ছেরি কিনা আমি। আপনার যেমন কথা। আর ভাববই বা কে! আপনের ঘরের দিকে কেউ ভুলেও ফিরা চায় না। সবার নজর আপনের সম্পত্তির দিকে। কবে মরবেন সেই আলাপ সবার মুখে।
কী করব বল। আমার কপালই খারাপ। না হলে ভাইদের জন্য কম করেছি। আমি ফিরে আসাতে সবার এমন অসুবিধা হবে জানলে কি আর গ্রামে ফিরি!
সবাইত চাইছিল আপনের ভিটা আর জমি ভাগ কইরা নিতে। এখন নিজের ভিটায় ফিরছেন আপনি। তাগো বাড়া ভাতে ছাই পড়ছে।
বলছিস, ফিরে আসাটা ঠিক হয়নি?
বেঠিকের কী আছে। নিজের বাপ-দাদার ভিটা। ... ভাবী আসব না?
ভাবীর আমাকে আর প্রয়োজন নেই। আমার কাছে যা চেয়েছিল পেয়ে গেছে। ঢাকার সব সম্পত্তি তার নামে। সে মেয়েদের নিয়ে ঢাকায়ই থাকবে।
তা ভাবী না আসুক। আমরাত আছি। হঠাৎ কইরা আসলেনত। প্রথম প্রথম অসুবিধা হইব। কদিন গেলে দেখবেন, বাস করার জন্য গ্রাম একেবারে খারাপ না।
না গ্রামতো দেখছি আর গ্রাম নেই। কত বদলে গেছে।
বদলাইব না! মানুষের টাকার অভাব আছেনি। ঘরে ঘরে এক-দুইজন কইরা বিদেশে আছেই। তাগ পাঠানো টাকায় গ্রাম বদলাইছে।
গ্রামে শীতটা বড় বেশি! হাড়ে পর্যন্ত গিয়ে লাগে। হাঁপানিটাও যেন এখানে এসে বড্ড বেড়ে গেছে। ঢাকায় অতটা বাড়াবাড়ি ছিল না। শ্বাস নিতে বড় কষ্ট। তুই যা এবার। শীতে কাঁপছিস। গায়েতো একটা শীতের কাপড়ও নাই।
আমার অত শীত লাগে না! কিছু আর লাগব আপনের? বাইরে যাওয়ার দরকার আছে?
বাইরে বলতে বাথরুমে। এমন সরাসরি জিজ্ঞাসায় লজ্জা পান সিদ্দীক। বলেন, না প্রয়োজন হলে আমি একাই যেতে পারব। ঢাকা থেকে এত পথ এলাম আর এইটুকু যেতে পারব না। এখনতো একাই করতে হবে সব।
আমি যাই তাইলে। শরীল ঠিকমতো ঢাইক্যাঢুইক্যা শুইয়েন।
পয়সা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে সিদ্দীক বিছানায় বসেন।
সিদ্দীক ছিলেন বাপ মায়ের বড় ছেলে। বড় হিসেবে সব দায়িত্বই পালন করেছিলেন তিনি। বেশি বেশিই করেছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর সতের বছর বয়সে ঢাকা গিয়েছিলেন সিদ্দীক। সংসারে তাদের অভাব হয়তো ছিল না। আবার প্রাচুর্যও ছিল না। আইএ পাস করার পর মামা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন। তবে পড়া ছাড়েননি সিদ্দীক। নাইট কলেজে ভর্তি হলেন। সেখান থেকে বিএ পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলায়। প্রথম দিকে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি আসতেন। তখন বাপ ছিল মা ছিল। ভাই ছিল বোন ছিল। সবার জন্য মন কেমন করত। তার জন্যও সবাই অপেক্ষা করত। বাপ-মা । ভাই-বোন। সবাই-ই।
আস্তে আস্তে চাকরিতে প্রমোশন হয়েছিল তার। তিন ভাইয়ের কেউই তেমন পড়ালেখা করেনি। তবুও তিন ভাইয়ের চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন বড় স্যারদের ধরে। সবই সরকারি চাকরি। যদিও বড় কিছু নয়। তা তাদের যোগ্যতাই বা কি। দুই বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন। শেষের দিকে তার বাবার হজে যাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। জমিজমা প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সে সব জমি তখন টাকা দিয়ে সিদ্দীকই কিনে নিয়েছিলেন। বছর বছর ভাইরাই চাষ করেছে সে সব জমি। হজে বাবা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। কারণটা এখনও তিনি ঠিক জানেন না। তবে কানাঘুষায় শুনেছেন, ছোট ভাইরাই যেতে দেয়নি। নগদ টাকা কী আর থাকে হাতে। এই সেই করে বাবার হাতের টাকা খরচ হয়ে গেল।
বিয়ে করেছিলেন ক্লাসমেটকে। বউ মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। বড্ড শোক পেয়েছিলেন বউ মরাতে। মেয়েই ছিল চোখের মণি। মেয়ের বেশিরভাগ সময়ই থাকত নানীর বাড়িতে। সবার পীড়াপীড়িতে আবার বিয়ে করেছিলেন। দরকারও ছিল। ফের বিয়ের পর মেয়ে পরই হয়ে গেল যেন। আসতই না আর কাছে। সৎ মাও মেয়েটাকে ভালো নজরে দেখত না। পরপর আরও দুটা মেয়ে হল। অবসরের পর যাত্রাবাড়ীর দিকে তিন কাঠা জায়গা কিনে সব সঞ্চয় মিলিয়ে বাড়ি করলেন একতলা। গ্রামের কিছু জমিও বেচতে হয়েছিল। কী দুর্গতি যে হয়েছিল, বউয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন সে বাড়ি। সবাই বুঝিয়েছিল হঠাৎ মারা-টারা গেলে মেয়েরা সম্পত্তির সবটা পাবে না। আইন মতে, ভাইয়েরাও ভাগীদার। ভাইয়েরাতো গ্রামের সম্পত্তি সবই খায়। আবার কষ্টের বাড়ির অংশও পাবে। এদিকে মেয়েরা সব নাবালক। ভেবে ভেবেই বউয়ের নামে বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন। বড় মেয়ে বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি। সম্পত্তিতে তারওতো ভাগ আছে। ততদিনে অবশ্য তার বিয়ে হয়েছে। জামাইয়ের চাকরিটাও খারাপ না। বিয়ের সময় তাকে অনেক কিছুই দেয়া হয়েছিল। তা হলেও সে সম্পর্ক আর রাখলই না বলতে গেলে।
বাড়ি লিখে দেয়ার পর বউয়ের ব্যবহার একবারে পাল্টে গেল। সারা দিন বাপের বাড়ির লোকজনকে নিয়ে থাকে। পাশের ঘরে সিদ্দীক অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। ফিরেও তাকায় না। মেয়ে দুটাও যেন মায়ের মতোই হয়েছে। সারা দিনেও একবার বাপের ঘরে উঁকি দেয়ার সময় নেই তাদের। একবারতো জ্বরে সারা রাত বেহুশ হয়ে ছিলেন। এত মানুষ বাড়ি ভর্তি। কেউ টেরও পেল না। ভাগ্য ভালো হঠাৎ ভাগিনা দেখতে এল। তখন খোঁজ পড়ল তার। সেই হাসপাতালে ভর্তি করাল। হাসপাতালে ছিলেন পনের দিনের মতো। নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল। হাঁপানিটা তখনই হল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আর দেরি করেননি সিদ্দীক। অত প্রিয় শহরেও মন টিকছিল না। বলতে গেলে একরকম পালিয়েই চলে এসেছেন গ্রামে। বউ-মেয়েরা যেন খুশিই হল তার চলে আসাতে। মাস পার হয়ে গেল এসেছেন, একবার ফোন করেও খোঁজ নেয়নি কেউ। তা খুশি হওয়ারই কথা। তিনি তো এখন তাদের কাছে আপদ। মরলে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসতে পারলে বাঁচে।
ভেবেছিলেন, ভাইরা ও ভাইয়ের বউরা বোধহয় খুশিই হবে তিনি ফিরে এসেছেন দেখে। একদিন-দুদিনের জন্য গ্রামে এলেতো বেশ সমাদরই করেছে। কিন্তু এসে বুঝলেন ভুল তার ধারণা। তিন ভাই ভাগাভাগি করে তার ভিটা আর সম্পত্তি খাচ্ছিল। বেশ গাছপালা লাগিয়েছে। ফলের কাঠের। তিনি পাকাপাকিভাবে ফিরে আসাতে তাদের সে সব ছাড়তে হবে এখন। খুশি না হওয়ারই কথা।
দেখতে দেখতে শীত যায়। এখন ফাল্গুন মাস। চারদিকে একটা উথাল পাথাল হাওয়া। সিদ্দীক এখন কিছুটা অভ্যস্ত পরিবেশের সঙ্গে। তার রান্নাবাড়া খাওয়া-দাওয়ার তদারকি সবই করে পয়সা।
পয়সা সিদ্দীকের একরকম আত্মীয়ই হয়। সিদ্দীকের মায়ের চাচাত বোনের ননদের মেয়ে। এক ভিটা পরেই তাদের বাড়ি। ছোটবেলা কত গিয়েছেন। বয়সকালে দেখতে শুনতে খারাপ ছিলনা পয়সা। সম্বন্ধও আসত অনেক। কেন যে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হল না।
রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে। পয়সা থালাবাসন ধুচ্ছে। কারেন্ট নেই অনেকক্ষণ ধরে। কুপির স্বল্প আলোতে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছিল পয়সা, তার দিকে তাকিয়ে সিদ্দীক বলেন, তোর অনেক দুঃখ, না পয়সা?
দুঃখ! তা কার না দুঃখ আছে। মানুষের জীবনে দুঃখত থাকেই। তা হঠাৎ এই কথা?
না, নিজের একটা সংসার হল না তর। সারা জীবনই বাপের বাড়িতে কাটিয়ে দিলি।
বিয়া হয় নাই বইল্যা কইতাছেন? আপনেত দুই দুইবার বিয়া করলেন। কই, খুব কি সুখে আছেন?
সিদ্দীক একটুক্ষণ চেয়ে থাকেন পয়সার মুখের দিকে। মুখময় বলিরেখা। মাথার চুল বেশিরভাগ শাদা। তাও সুন্দর দেখায় পয়সাকে।
আচ্ছা পয়সা, একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছা করছে। তুই এত কষ্ট করছিস কেন আমার জন্য?
পয়সার জবাব নেই। একবার তাকায় সিদ্দীকের দিকে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, খালি এক কথা আপনের। তর কষ্ট হয়। তর কষ্ট হয়। আপনের লাইগ্যা কী এমন করি যে কষ্ট হয়। দুই বেলা রান্না, তার বেশিত কিছু না। বুড়া হইছি তাই বইল্যা অথর্বত না।
একটু বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। যাবি নাকি?
রাত কত হইল খেয়াল আছে!
বেশিক্ষণ থাকব না। কেমন চাঁদ উঠেছে বাইরে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। দেখতে ইচ্ছে করছে।
চাঁদ বুঝি আইজ নতুন উঠল! প্রতি মাসেই পূর্ণিমা হয়। তা ছাড়া এখনও শেষ রাতে হিম পড়ে। আপনেরত শ্বাসের কষ্ট আছে। যদি বাড়ে।
থাকব না বেশিক্ষণ। কারেন্টওতো নাই। বাইরে বসলে ভালো লাগত।
আমি বাইরে একটা জলচৌকি দেই।
বাইরে তখন ফুটফুটে জোছনা। বাড়ির শেষে সরিষা খেতে জোছনায় জোয়ার। ধনিয়া ফুলের গন্ধ বাতাসে। চালতা গাছের ডালে রাতজাগা কী একটা পাখি ডেকে উঠে। ... জানস পয়সা, আমি এখন পশু-পাখিদের কথা বুঝতে পারি।
হঠাৎ সিদ্দীক তরল স্বরে বলেন।
হ। পশু-পাখিগ কথা বুঝতেতো পারবেনই। আপনি তো পাগল। একবার আপনার মাথা খারাপ হইছিল, ভুলি নাই আমি।
সেতো গ্রামের সবাই জানে। খোটা না দিলেও চলে।
খোটা দেই না। খালি মনে করাইয়্যা দিলাম।
চালতা গাছের পাখিটা কী বলছে জানিস? বলছে, সিদ্দীক নামের এই মানুষটা কী বোকা। সারা জীবন ভালোবাসা খুঁজেছে। অথচ তার জন্য একজন ভালোবাসা নিয়ে বসে ছিল। টেরও পায়নি। ... আচ্ছা পয়সা, একটা ব্যাপার আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। তোকে কি আসলেই পছন্দ করত না পাত্রপক্ষরা?
করত না বলি নাইত। করলেও আমিই রাজি হইতাম না।
কেন!
বিয়ে হলে কোন গ্রামে চলে যেতাম। ... আপনি মাঝে মাঝে আসতেন গ্রামে। দেখতাম। তা চোখের দেখায়ও অনেক সুখ আছে। আপনে ঠিক বুঝবেন না। বিয়ে হইয়্যা দূরে গেলেগা দেখতে পাইতাম আপনেরে। খালি অপেক্ষা করতাম কবে আইবেন আপনে। আইসা আইসা খালারে জিজ্ঞেস করতাম কবে বাড়ি আইবেন আপনে। আপনের মাও আমারে খুব পছন্দ করত।
এ সব যে সিদ্দীকের একেবারে অজানা তা নয়। তবে যেন ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। ... সিদ্দীকের মা ছেলের বউ হিসেবে পয়সাকে পছন্দ করেছিলেন। বিয়ের কথাও এগিয়েছিল বহুদূর। কিন্তু মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে পছন্দ হয়নি তার। পড়ালেখা জানত না বলে অশিক্ষিত পয়সাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। তখন সিদ্দীক মাত্র ম্যাট্রিক পাস করেছেন। ঢাকা পড়তে যাবেন, সব ঠিকঠাক। তার মনে তখন অন্যরকম স্বপ্ন। আরও পড়বেন, ভালো একটা চাকরি করবেন। বিয়ে করবেন পড়াশোনা জানা শিক্ষিত একটা মেয়েকে।
আজকালকার যুগে এমনও হয়! মানুষ মানুষকে এতদিন মনে রাখে!
আমিত আজকালকার মানুষ না। আমার বয়স না হইলেও ষাইটত হইবই।
সিদ্দীক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। কী ভেবে পয়সার মুখের দিকে তাকান। আলগোছে জিজ্ঞেস করেন, তা তুই পড়ালেখা শিখলি কার কাছে?
ভাতিজির কাছে। ... ভাইগ কাছে আছি বলে তারা যে অনাদর করে তা না। আমি বলতে গেলে সারা দিন আজাইরই থাকি। ভাতিজিরে একদিন ধরলাম আমারে পড়তে শিখানোর লাইগ্যা। ... এখন নিজে নিজেই সব পড়তে পারি। যা পাই হাতের কাছে তাই পড়ি। নাতি নাতনিগ বই। পেপার। দোয়ার বই। যা পাই। ... মাঝে মাঝে ভাবি সময় মতো যদি পড়ালেখাটা শিখতে পারতাম তাইলে আমার জীবনটা হয়তো অন্যরকম হইত। ... রাত বাড়তাছে ঘরে চলেন।
রাত আসলেই বেড়েছে। চারপাশ কেমন নিঝুম। চালতাগাছের পাতায় শিশির জমে জমে টুপটুপ ঝরে পরছে মাটিতে। কোথায় যেন ঘুমহারা একটা পাখি করুণ স্বরে ডাকছে। ... ঘর! সিদ্দীক কেমন আনমনা স্বরে বলেন।
এতক্ষণ বাইরে বইয়া রইছেন, আবার না কাশি শুরু হয়। উঠেন। আপনারে ঘরে শোয়াইয়া দিয়া আমিও যাই।
ঘর! ঘর! ...হ্যাঁ, ঘরে যাওয়া দরকার। ...জীবন কী আর অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। যেমন হয়েছে তেমনই বোধহয় হওয়ার কথা ছিল। এক জীবনে মানুষ কত যে ভুল করে। এই যে তুই, ভুল সময়ে শিক্ষিত হলি।
ঐ দেখো। একটু আধটু বাংলা পড়তে পারি বলে আমি নাকি শিক্ষিত। আপনি যেমন শিক্ষিত মেয়ে পছন্দ করেন আমি তেমন শিক্ষিত না। ...ঘরে চলেনতো। রাত কি বাইরে বইসাই কাটাইয়্যা দিবেন নাকি।
না বাইরে কী আর বসে থাকা যায় চাইলেই। রাত কাটানোর জন্য আশ্রয়তো একটা লাগেই। চল্। সিদ্দীক উঠে দাঁড়ান।

Comments