এ্যানিমল ফার্ম :
বিশ্বসাহিত্যের সমঝদার পাঠক মাত্রই জানেন জর্জ অরওয়েল নামের ইংরেজ
কথাসাহিত্যিক ১৯৪৫ খৃস্টাব্দে পশুখামার নামে এক
ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস লিখে হৈ-চৈ ফেলে দেন। সেই থেকে সাহিত্য জগতে এ্যানিমল ফার্ম
বা পশুখামার নামটি ব্যাপকভাবে
পরিচিত হয়ে ওঠে। উপন্যাসটি বাঙালি পাঠক-পাঠিকারা অনেকেই অনুবাদের মাধ্যমে আগেও
পড়েছেন। জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক আনিস হকের অনুবাদে অরওয়েল
নতুনভাবে পরিচিতি হয়ে উঠছেন বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে। বিপিএল বইটি প্রকাশ করে একটি
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু অভিনব ও ব্যতিক্রমধর্মী বলেই চিন্তাশীল পাঠকসমাজ এর
প্রভাব-বলয় থেকে সহজে বের হতে পারেন না। পশুর প্রতীকে পশুদের বয়ানে মানুষের পশুর
আচরণ নিয়ে এমন স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সমালোচকবৃন্দ
উপন্যাসটিকে ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছেন। আনিস হকের ঝরঝরে অনুবাদেও
উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। পড়া শুরু করলে শেষ না করে ফেলে রাখা যায় না। কাহিনি
টেনে নিয়ে যায় এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে। ভাষান্তরের সাধারণ আড়ষ্টতা নেই বললেই চলে।চিন্তা জগতের কোনো প্রপঞ্চ যদি মানুষকে নতুন করে ভাবাতে না পারে, কিংবা নতুন সৃষ্টির বিস্ময়ে মনকে জাগাতে না পারে তাহলে সে কিসের নতুন প্রপঞ্চ বা নতুন সৃষ্টি। যে সমস্ত মতবাদ নিয়ে মানুষের অহংকার, গর্ব, রক্তপাত, অবিবেচনা, শিশুসুলভ জিজ্ঞাসা, অরওয়েল সেই সমস্ত বিষয়কে দেখতে চেয়েছেন নিজস্ব চোখে। মানুষের মুক্তির প্রশ্নে পৃথিবীর প্রথম সত্য কি, মানুষের মুক্তির প্রশ্নে পৃথিবীর শেষ সত্য কি– এ-সব প্রশ্নের কোনো উত্তর এই আধুনিকতাবাদী সমাজেও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ধর্মের নামে, মতবাদের নামে মানুষকে বাধ্যমানুষ করার অধিকার কেন মানুষ হাতে তুলে নেবে! কেন আঁকড়ে থাকবে যে কোনো মতবাদ! কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে বসে থাকার নামই হচ্ছে মৌলবাদ। সেটা চিন্তা, মতবাদ, ধর্ম, ঐতিহ্যও হতে পারে।
আবার পৃথিবীর সমস্তকে ছেড়ে দিয়ে যে যার মত করে জীবন যাপন করাও এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। এই স্বেচ্ছাচারিতা কারও কাম্য নয়। এইজন্য মানুষের মুক্তি নিয়ে মানুষ ভেবেছে বারবার। কিন্তু মুক্তি সে পায় নি। আধুনিক পৃথিবী এখন নরক। হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া সমস্ত অর্জনকে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। আদিতে মানুষের মুক্তি যে তিমিরে ছিল এখনও তার চেয়েও কম তিমিরে রয়েছে কি?
মানুষের মুক্তি নিয়ে পৃথিবীতে ঘটল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষের সমাজ ছিল মানুষের জন্যই। সেই সমাজ ব্যবস্থা বিকশিত হয়ে যখন পুঁজিবাদী সমাজে ধাবিত হল তখন পৃথিবীর সমস্ত মূল্যবোধ তছনছ হয়ে গেল। পুঁজিবাদী সমাজের পূঁজের দুগর্ন্ধ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সম্পত্তি অর্জনই হয়ে উঠল কিছু মানুষের কাছে বড় মুক্তি। আর যারা সম্পত্তি অর্জন করতে পারল না তারাও চাইল মুক্তি। আবারও এই দুই চিন্তার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠল। এভাবে দ্বান্দিক নিয়মে পৃথিবী এগিয়ে চলছে তার শেষ পরিণতির দিকে।
জর্জ অরওয়েল তার এ্যনিমল ফার্ম এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন কোনো মতবাদেরই পূজা করা যাবে না। পূজা করা যাবে শধুু মহাজগতের শেষ সত্য বা প্রথম সত্যকে। এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে মানুষের চরিত্রকে ফালি ফালি করে বীক্ষণ করা। পশ্চিম থেকে পূর্বে এ যাবৎকালে সভ্যতার নামে মানুষের যে অর্জন তা শুধু পশুর গর্জন ছাড়া আর কিছু নয়, সেই দিকে মানুষকে নতুন করে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছেন তিনি। পশুর চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখালেন- শাসনদণ্ড হাতে পাওয়ার পর সুবিধাভোগী মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সচেষ্ট থাকে, পূরণ হয়ে গেলে সে কথা আর মনে থাকে না। মানুষ তো পেছনে ফিরতে পারে না। উপন্যাসের শেষে এসে সবচেয়ে বড় চমক দেখালেন অরওয়েল : মদের পাত্র হাতে শুয়োর ও মানুষ যখন চেঁচামেচি শুরু করল, পরস্পর দোষারোপ শুরু করল, তখন কে শুয়োর আর কে মানুষ সেটা চেনার উপায় থাকল না। অরওয়েল বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষকে উদ্ধারের নামে যারা বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন, কিংবা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন বিপ্লব, তারাও আসলে ছদ্মবেশী। এত রক্তপাতের ভেতর দিয়েও আখেরে মানুষের কোনো লাভ হল না। মানুষ চায় যে মুক্তি তা তার ঘটল না, ঘটল তার উল্টোটা, বন্দীত্ব। কেননা, সংকটের নানা চেহারা নিয়ে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হল, এক তন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত আরেকটি ভাল তন্ত্রের মন্ত্র পড়েও মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন করতে পারল না। যারা দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দেয়, প্রাণপণ যুদ্ধ করে নতুন বিপ্লব সফল করে, দেশ মুক্ত হয়ে গেলে বিপ্লব সফল হয়ে গেলে রাজাজ্ঞার প্রথম দণ্ডটাই তাদেরকে দণ্ডিত করে। সেটা আমরা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে যেমন দেখেছি, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও দেখেছি। তাহলে দর্শনের চরিত্রগত দিক থেকে রাষ্ট্র দুটির কী পার্থক্য থাকল? অরওয়েল সেই বিষয়কে এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, মানুষকে পশুদের চেয়ে বর্বর বলতে বাধ্য হলেন।
আসলে মানুষ বড় আজব চীজ। এই চীজকে বুঝতে পারা পৃথিবীতে কারো সাধ্য নেই। সাধ্য নেই বলে মানুষ বারবার অসাধ্য সাধন করে। সাধনকে আবার নিজের হাতে নষ্টও করে। পশুমানুষ, মানুষপশুরাই সাধারণ মানুষের সমস্ত অর্জনকে আত্মসাৎ করে।
অনুবাদকের জবানে, ‘তিন বছর
আগে বইটির জার্মান অনুবাদ পড়ি। সবার উপরে মানুষকে দেখি। অর্থ, প্রতিপত্তি বা নাগরিকতার সংজ্ঞাবদ্ধতায় যে সব মানুষের নিচের তলায় স্থান,
তাদের পশুর মতো প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে দেখে ব্যথিত হই। তাদের
রক্তগঙ্গায় যে বিপ্লবের জোয়ার বয় কিছু সুবিদাবাদী, সুবিধাভোগী
আর সুযোগসন্ধানী মানুষের কারণে সে বিপ্লব বিফল হয়, তখন
হতাশায় বুঁদ হয়ে যাই। অরওয়েল যেন তার এই বইতে আমার (এখানে বুঝতে হবে- আমাদের)
হতাশাকে তুলে ধরেছে’। শেষ-মেশ মানুষের কী হবে। মুষ্টিমেয় মানুষের ইন্দ্রিয় সুখযাপনের
মধ্য দিয়ে কি শেষ হয়ে যাবে এ জগত! পৃথিবীর প্রথম মহাকব্যের নায়ক গিলগামেশের মত
মানুষের মন ও শরীরের মুক্তি বা স্বাধীনতা নিয়ে আফসোস করা ছাড়া কিংবা ঘোরের মধ্যে
থাকা ছাড়া মানুষের সামনে কিংবা পিছনে কি কোন পথ নেই? বলা
যেতে পারে, এই আপাত-উত্তরহীন জিজ্ঞাসাকে আমাদের মাঝে
প্রতীকায়িত ব্যঙ্গে ও রহস্যে উসকে দিয়েছেন অসামান্য কথাবার জর্জ অরওয়েল। আনিস হক
তারই এক নবায়িত বাংলা-ভাষ্য হাজির করেছেন প্রশংসনীয় ভঙ্গিতে। আক্ষরিক অনুবাদ নয়,
বরং লেখকের অভিপ্রায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এক ধরনের
ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষার বাকভঙ্গি, সংলাপ
ও বাক্যরীতিকে গ্রহণ করে। ফলে তার অনুবাদ মূলের মতো সুখপাঠ্য। এজন্যে অনুবাদক ও
প্রকাশক দুজনকে ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment