দূর গাঁয়ের মানুষেরা - আজাদুর রহমান


দূর গাঁয়ের মানুষেরা

আজাদুর রহমান


রামনগরকে টার্গেট করে পথে নামতে হলো। সাবেকি ঢঙের পথ নয়, সবুজ কামিজ জড়ানো কেউটে পিচ। শ্যামলা গাছালিকে দরদ করে লাগায়নি কেউ। মানুষের অবহেলাই শাপেবর হয়েছে। নিরালা পেয়ে মর্জি মতন কাছে এসেছে- গাছ, মাটি আর আকাশ। ওদেরই নিগূঢ় সহবাসে জমে আছে চার পাশ। খিলানতোলা অরণ্যের ছিদ্রপথে হাওয়া বদলাতে বদলাতে ছুটে চলে মোটরসাইকেল। স্পিড বাড়িয়ে দিই। আমরা হয়ত দ্রুত সবুজ টানেলের
ওপারে যেতে চাই। পারি না। হঠাৎ ফাঁকা ফ্রেমের মধ্যে চিংড়ির ঘের ঢুকে যায়। অমন ঘের-দরিয়া কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কে জানে? জলাভূমি ছেড়ে দিয়ে নাদুসনুদুস ধানক্ষেত। তারপর জলাভূমি, ফের ধানক্ষেত লাফ দিয়ে দিয়ে থিতু হয়েছে জঙ্গলের পায়ের তলায়Ñ ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে আসে সুদূরের গুটি ধরা গ্রামগুলো। নজরবন্দী হতে-না-হতেই দৃশ্য ভেঙে যায়, ঝাঁক ঝাঁক ধবধবে বক এরোপ্লেনের মতো উড়ে এসে লাগাতার পড়তে থাকে আবাদি জমির ক্ষণেক বিরতিতে। অবতরণ করতে যতক্ষণ, ধ্যানস্থ হতে আর সময় লাগছে না। ধ্যানী বক-দলকে কোনোভাবেই আর সংজ্ঞায়িত করা যায় না, উল্টো একেকটা বককে একেকজন পুণ্যবান শিক্ষকের মতো মনে হয় যেন। এরপর আমরা কোনোভাবেই আর অতীতগ্রস্ত হতে পারি না, যেতে যেতে কেবল নীল জলেশ্বরীর বয়ান শুনি, কান খোলা রাখি। আরো দক্ষিণে যাই। নোনা বাড়ে, শিশির কেটে রেওয়াজ করে দেখা দেয় পাথারিখেজুর। আমরা ফিংড়ি হয়ে আনমনেই সাপের পথে ব্যাংদহে চলে যাই। ব্যাংদহের সবখানেই খেজুর-বলি, সৌদি আরব চলে এলাম না তো! 
কুয়াশার সাথে পাল্লা দিয়ে চঞ্চলতা বাড়ছে। থামলে চলবে না। দেহ পুরোপুরি রসে ভরে উঠলে গাছিদের আর জো থাকবে না! ভরবছর একরকম হাত গুটিয়েই থাকেন তারা, কিন্তু পৌষ পড়লেই দপ্ করে জ্বলে ওঠে শিবলিপাড়া। নরম নিরাক মেখে তারা তাই মাঠ থেকে মাঠে বেরিয়ে পড়েন- ‘গাছি’ নয়, দক্ষিণাঞ্চলে সহজ পরিচয় ‘শিবলি’।
পথিকের মুখের ঠিকানা মেনে নতুন করে বামের সরু রাস্তায় নেমে পড়ি। ক্রমেই ফসলের আনুকূল্য। মেঠোপথ এঁকেবেঁকে যেতে যেতে নিরুপায়ে পিচে ধরেছে। হাত পঞ্চাশেক পর আরো একটা মামুলি রাস্তা খামোখা গায়ে পড়ে ত্রিমোহনা করেছে। ওখানেই গোটাকয়েক ঝুপড়ি মতন দোকান আছে। সার বেঁধে গাঁওয়ালিরা দোকানে রাখা টেলিভিশনে ভিডিও দেখছে। করিমগাছির ছেলে আশরাফুলকে বাজারেই পাওয়া গেল। ভ্যান চালায়। পরিচয় পেয়ে আগবাড়িয়ে আমাদেরকে ভ্যানে উঠে বসতে বলে সে। আমরা ইতস্তত করি। আশরাফুল আশ্বস্ত করে; চাচার দোকানে মোটরসাইকেল রাখেন, কুনো অসুবিধা নাই। আমাদের বাড়িটা তো পাথারের মদ্দিখানে ওকানে মোটরসাইকেল যাপে না, তা ছাড়া খেতির মদ্যি দি যাতি হবি; আইলে কাদা আছে। অগত্যা মোটরসাইকেল ফেলে আমরা খোলা ভ্যানে উঠে পড়ি। আড়াজঙ্গল আর কাঁচা পথ পেরিয়ে পুকুরপাড়। নামতে বলাতে হাঁফ ছাড়িÑ ‘আমরা তাহলে এসে গেছি, নাকি’? আশরাফ হাসিমুখে আঙুল উঁচিয়ে পাথারিবাড়িটা দেখায়। ধানকাটা মাঠে হেঁটে হেঁটে আমরা বাড়ির উঠোনে যাই। 
ছয়-সাত ঘর মানুষ নিয়ে দ্বীপ মতোন ফ্যালনাপাড়া। আশরাফ দুটো কাঠের চেয়ার ডাবগাছের তলে এনে পেতে দিলে আমরা বসে পড়ি। মিনিটের মধ্যে পাড়ার বাচ্চাগুলো জড়ো হয়ে গেল। ওরা ভিড় করে ভিতুমুখে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু অন্যদের মতো গা টেপাটিপি করে না। করিমের একটাই ঘর। করিমের স্ত্রী বিলকিস ছাপড়াতলে চুলায় ভাত চড়িয়েছেন। হেঁশেলে জ্বালানি ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর কোমরে শাড়ি গুঁজতে গিয়ে লাজুকমুখে জবাব দেন, ‘উনিয়ে তো হোসেনপুরে বাঁশ কাটতি গ্যাছে’। ছোট জা ফাতেমা কথা কেড়ে নেনÑ ‘আফনেরা বসেন, অখনি আইসে পড়বি’। কোন ফাঁকে আশরাফুল দা হাতে কোনাকুনি পা ফেলে কায়দামতো পাশের ডাবগাছটায় উঠে যায় এবং প্রায় সাথে সাথেই গোটা তিনেক ডাব হাতে নেমে আসে। তারপর ডাবগুলোর মুখ কেটে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ন্যান’। মোঙ্গার বাজারে একটা ভ্যানওয়ালা এভাবে আপ্যায়ন করতে পারে ভাবাই যায় না। আমরা পরস্পর মুখে মুখ রাখি কিন্তু ধন্যবাদ দেই না বরং টাট্কা টলটলে পানি ডাব উপুড় করে গেলাসে ঢালি। তারপর ঢক্ঢক্ করে খেয়ে আরামের আহ্ শব্দ করে ফের দিগি¦দিকে চেয়ে দেখি। শরিফুল এক কোপে কাঁচা ডাব দুটো দুই ফালা করে আমাদের মুখের সামনে তুলে ধরে। হ্যাবলা হয়ে প্রশ্ন করি, করো কী! শরিফুল দাঁত বের করে হেসে ওঠে, বলেÑ ‘কোমলা শাঁস; আফনারা খাবেন তাই’। কিছু বলার থাকে না। অন্যমনস্কের মতো ইতিউতি চোখ ঘোরাতে গিয়ে দৃশ্যটা আটকে যায়। লাগোয়া পুকুর থেকে দু’ঘর বাদের এক মহিলা গোসল সেরে ভেজা শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে দ্রুত হরিণের মতো পা ফেলে লাউয়ের মাচার তলে চলে যায়। অগত্যা আমরা সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে আনি। কিন্তু দৃশ্যটা মাথার ভেতর বেশ খানিক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে। তারপর একসময় ছবিগুলো হাবিজাবি রেখাময় হয়ে মিলে গেলে রোদেলা মাঠে লম্বা পা ফেলে দোহারা করিম ফিরে আসে। জওয়ান মানুষ। গতর খেটে খেটে তার পেশিগুলো কামারদের মতো গোটা গোটা হয়ে গেছে। নতুন করে কথা জমে।
খবর পেয়ে হোসেনপুরের আজাহারুল, আবদুর রহমানসহ পার্শ্ববর্তী গাছিরা হাজির হন। গল্পগুলো শেষ হতে চায় না, ডালে ডালে ছড়িয়ে যেতে থাকে। কথার লাইন থাকে না। গাছ বাইতে বাইতে করিমের একটা ঠিকানা হয়ে গেছে। গাছে হাত দিলেই তিনি রসের ভাবগতি বুঝতে পারেন। রস পুরা হলে প্রথমে কাঁটাওয়ালা ডালপালাগুলো কেঁটে চাঙ্গড় তুলতে হয়। এ হলো ‘গাছতোলা’। চার-পাঁচ দিন বাদে কোনাকুনি কাটিং করে ডিজাইন দিয়ে দিন কয়েক শুকান দেয়া লাগে। এর নাম ‘হিরকাটা’। হিরকাটা’র চার-পাঁচ দিন পর ফুল চাঁছ দিলে কাটা পথ ধরে রস নামতে শুরু করে। রসকে এক পথে আনতে নলিন-খিলিন করতে হয়। মানে আগারি কঞ্চি ফেঁড়ে ফালির চোখা মাথা ড্রেন কাটা পয়েন্টে ঠুকে ঠুকে মারতে হয়। এবারে দু-পাশে খিলান পুঁতে ভাড়া ঝুলিয়ে দিলেই হয়ে গেল। গাছতোলা, হিরকাটা এবং ফুল চাঁছÑ এক দায়ে হয় না। দায়ের বর্ণনার ফাঁকে বিলকিস গলা তোলেনÑ ‘উ লোকের বছরে চার-পাঁচখান দা লাগে। বিয়ের পর থেকেই দেকছি সে গাছ কাইট্যে। উ তো একলাই বিশ গণ্ডা করে গাছ কাটে। উ আবার বেশি ছাড়া কম কাটতি পারে না।’ স্বামীর এহেন তাকত তুলতে গিয়ে তার মুখে লজ্জা এবং গর্ব একসাথে মিশেল হতে থাকে। আমরা সে দিকে খেয়াল করতে চাই না, অন্য কথা তুলি। গল্পগুলো নরম হতে শুরু করে। খেজুরের গল্পের সাথে যোগ হয় বিলকিসের পারিবারিক বিষয়-আশয়। প্রথম স্ত্রী বছর বিশেক আগে মারা গেলে কলারোয়ার বিলকিসকে বিয়ে করে এনেছিলেন করিম। আগের স্ত্রীকে নিয়ে বিলকিসের আলাদা কোনো বিকার নেই বরং তার শরীরের বাঁধন বেশ মোটা। মামুলি বিষয় তাকে কোনো দিনই ভাবিয়ে তোলেনি। আশরাফুল আগের স্ত্রীর দিককার হলেও বিলকিস পেটের সন্তানের মতোই দেখভাল করেন ওকে। এ রকম নিরীহ অথচ সুখমুখো পরিবারের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমরা হয়তো খেই হারিয়ে ফেলি, সাবজেক্ট ফেলে অন্য দিকে যেতে থাকি। রহমান গাছি রসের গুণাগুণ নিয়ে ফেরত আসেন- চাঁছা গাছে দুই দিন রস টেনে ফের তিন দিন লাগাতার শুকান দিতে হয়। তারপর আবার হাঁসুয়ায় চেঁছে জমানো রস দুই দিনে নামাতে হয়। পয়লা রাতের রসের নাম ‘জিরান রস’। পরের দিন-রাতের রস হলো- ‘ওলা রস’। ওলা জিরানের মতো অত সুস্বাদু নয়- ঘোলা ঘোলা, হালকা কিসিমের। গুণী জিরান রসে হয় সুমিষ্ট পাটালি। অন্য দিকে ওলা রস জ্বালালে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। ও থেকে বড়জোর ঝোলাগুড় পর্যন্ত যাওয়া যায়। প্রতিদিন চাঁছা যায় না? করিম হেসে ফেলেনÑ ‘শোনেন, রস নামানি বুজানিতে বেশ জ্ঞিয়ান খাটানি লাগে। যেমন ধরেন ডেইলি দিন যদিল গাছ কাটি তালি পরে রস হলদে হয়ে সময়তি গ্যাজা উঠি যাপে। রস আর ভালো হবি না। আবার ধরেন, যদি আমি শুকানি না দিয়ে ফির ভাড়া দি তাহলিও টক রস বের হবি। তবে পুষের (পৌষ) মদ্যিখানে তিন দিনের দিনও রস নামানি যায়। ওগাকে নিমঝড়া বলে। রস নামা-পাড়ার প্রত্যেক বারে বারে ভাড়া পাল্টানি লাগে’। আলাপের মদ্যিখানে বিলকিস করিমের হাতে পান দিয়ে যান। করিম জর্দাভেজা পান মুখে গুঁজে দিতে গিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হন- আপনেরা পান খাবেননি! দূরবর্তী বিলকিসের হাসিমুখে আবারো লজ্জা জমতে শুরু করে- ‘আপনেরা ভাত খাইয়ে যাবান। খালি অ্যানা ডিম ভাজি করা লাগবি’। বিলকিসের এহেন আবদারি শুনে হাসিমুখে বলি- আবার এক দিন আসবো, তখন খেয়ে যাবো। বিলকিস হয়তো বিশ্বাস করতে চান না, আগের মতোই সলজ্জ মুখে সবার মুখপানে চেয়ে থাকেন তিনি।
মওসুমে এমনিতেই রস জ্বালানো ও ঘরকন্না নিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন বিলকিসরা, তার ওপর পৌষ-মাঘে যখন রসের চাপ বেড়ে যায়, তখন মাটিতে ভালো করে পা পাতার সময় থাকে না আর। বিলকিস নিজেই সেসবের বয়ান করেন- ‘পরিশ্রম তো হয়ই। ছয় মাস খুব ঝামিলা হয়। গুড় জ্বালিয়ে রান্নার জো হয় না।’ তবুও তার মুখটাকে দুঃখিত মনে হয় না। জিজ্ঞাসা করি- এ কাজ করতে আপনাদের কেমন লাগে? কোনায় বসা রহমান গাছি গলাখাকাড়ি দেন- ‘কাজের কতা কী বল্বো, একবার তো করিম গাছ থেকে দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গিয়িলো। অনেক দিন তর ধরেন বিছানায় পড়ে ছ্যালো। তয় কাজ আমাদের ভালোই লাগে। জোন খাটা ছাড়া অন্য কাজ পারি না। বছরের ছয় মাস এ কাজ করার পর বাদবাকি সময়তি জোন খাটি। এত কাজ করেও আমাদের দিন আর ঠিকমতো চলে না। খেয়ে-না-খেয়ে ধরেন কঠিন কাজগুলান করানি লাগে। কী করা যায় কন্! তাও যদি আমাদের কিছুটা মান দিত। লোকে তাচ্ছিল্য করে। গাছির কাজটাকে মানুষ ছোটশ্রেণীর কাজ মনে করে।’ আবদুর রহমান একটানা বলে যান। একটা বিষণ্ন ধোঁয়া যেন ছড়িয়ে পড়তে থাকে সবখানে। হাল্কা করতে প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করি- খেজুরের কাঁটা ফোটে না? প্রশ্নের জবাবে কেউ তেমন আমল দেয় না। বলে, এগুলো তো হালকা, মামুলি ব্যাপার। 
... গোধূলি নামে। ম্যাচে দেশলাই ঠোকার আগে করিম বিড়িমুখে আরো কিছু কথাবার্তা চালিয়ে যান। মনোযোগ থাকে না, পেছন পথের কথা ভেবে আমরা ভেতরে ভেতরে উসখুস করি। তারপর আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো সুতো ছেঁড়া হয়ে গেলে উঠে পড়ি। কেউ কেউ পাথার পার করে দিতে আসেন। গেরুয়া আবাদ চিড়ে আমরা ফিরতে থাকি। পাথার শেষ করে বাঁক নিতে গিয়ে শেষবার রামনগরকে দেখে নিই। অস্তাচলের আলসে আলোয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে গাছিগাঁও।

Comments