মোহাম্মদ আলীর ইসলামে ফিরে আসার কারণ


বাংলাদেশের পতাকা হাতে আলি



যার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। এ দেশের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেণ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লুইসভিল কেন্টাকিতে আফ্রিকার-আমেরিকান এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ক্যাসিয়ার মার্কাস ক্লে। তার বাবা ক্যাসিয়াস মার্কাস সিনিয়র ছিল পেশায় একজন সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড পেইন্টার। মা ছিলেন গৃহিণী।
জন্মের সময়ে তাঁর নামকরণ করা হয় ক্য়াসিয়াস মার্সেলাস ক্লে নামে। এই নামে ১৯ শতকে একজন দাসপ্রথা বিরোধী নেতা ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই আলির নামকরণ হয়।
সাইকেল চোরকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। সেই সূত্রেই বক্সিং শিখতে শুরু করেন মহম্মদ আলি। সালটা ছিল ১৯৫৪। তাঁকে পথ দেখিয়েছিলেন কেন্টাকির লুইসভিলের পুলিশ অফিসার জো মার্টিন। যিনি একজন বক্সিং ট্রেনারও ছিলেন।

কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া ছোটবেলা থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ মানুষের অবজ্ঞার শিকার হন। শ্বেতাঙ্গ মানুষের চেয়ারে তাদের বসতে দেয়া হতো না। এমন কি একজন বিশ্বসেরা বক্সার হওয়ার পরও তাকে শ্বেতাঙ্গদের হোটেলে খাবার দেয়া হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা ও শ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। এ থেকে মুক্তির একটা পথ খুঁজছিলেন।
১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর হয়ে সেখানে যেতে অস্বীকার করেন মহম্মদ আলি। এর ফলে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। তাঁর বক্সিং লাইসেন্স বাতিল করে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাথলেটিক কমিশন। আলির পদক কেড়ে নেওয়া হয় ও ১০ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি পান আলি।
১৯৬৪ সালে ‘নেশন অব ইসলাম’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে পরিচিত হন। তারা আফ্রিকা ও আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করতো। তাদের সংস্পর্শে গিয়ে ইসলামকে বুঝতে শেখেন তিনি। ইসলাম শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কোনো পার্থক্য ও ব্যবধান রাখে না বলে জানতে পারেন তিনি। এতে এক সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী নাম ধারন করেন। ‘নেশন অব ইসলাম’ সংগঠনটির সঙ্গে ‘ইসলাম’ শব্দ থাকলেও তারা শুধু ইসলাম নিয়ে কাজ করতো না। তারা ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে সমন্বয় করে একটি নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। বিষয়টি পরে বুঝতে পারেন মোহাম্মদ আলী।
এতে ১৯৭৫ সালে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুন্নী মুসলিম হন। এরপরই তিনি নিজেকে প্রকৃত মুসলিম বলে পরিচিত করতে থাকেন। এক সময় তিনি বলেন, ‘আমাকে যদি বক্সিং ও ইসলাম- এই দুটোর মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে অবশ্যই আমি ইসলামকে বেছে নিবো’। ইসলাম গ্রহণের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভেদাভেদ দূর করতে কাজ করে গেছেন তিনি। সর্বশেষ ২০০৫ সাল থেকে ইসলামের সুফিবাদের সংস্পর্শে আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুফিবাদ চর্চা করেন মোহাম্মদ আলী।
আমাকে যদি বক্সিং ও ইসলাম- এই দুটোর মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে অবশ্যই আমি ইসলামকে বেছে নিবো’।
-- দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী।
** ALLAH is the Greatest **

মোহাম্মাদ আলী হচ্ছেন সাবেক মার্কিন মুষ্টিযোদ্ধা, ৩ বারের ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাপিয়ন এবং ওলিম্পিক লাইট-হেভিওয়েট স্বর্ণপদক বিজয়ী। ১৯৯৯ সালে মুহাম্মদ আলীকে বিবিসি এবং স্পোর্টস ইলাট্রেটেড স্পোর্টসম্যান অব দ্যা সেঞ্চুরী (শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ) হিসেবে ঘোষণা করে।
মোহাম্মাদ আলী প্রথম জীবনে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারি ছিলো, তখন তার নাম ছিলো ক্যাসিয়াস মারকেলাস ক্লে জুনিয়র। ১৯৬৪ সালে তিনি নেশন অব ইসলাম (Nation of Islam- NOI) নামক একটি দলের সাথে যোগদান করেন এবং নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দান করেন। নেশন অব ইসলাম নামক সংগঠনটি ছিলো ডেট্রয়েট ভিত্তিক কালোদের একটি সংগঠন, এরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করলেও আসলে সংগঠনটি ছিলো কাদিয়ানী টাইপের সংগঠন, যারা আরো নবীর আগমনে বিশ্বাসী।
১৯৭৫ সালে অবশ্য মোহাম্মাদ আলী ভুল বুঝতে পারেন এবং নতুন করে সুন্নী মুসলিম-এ কনভার্ট হন। ১৯৮০ সালে রহস্যজনক ভাবে তার পারকিনসন রোগ ধরা পড়ে এবং প্রচার করা হয় বক্সিং খেলার কারণেই সে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এবং এতেই তার ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে।

অনেকেই বলেছেন- বক্সিং খেলার কারণে নয় বরং সিআইএ পয়জন প্রবেশ করিয়ে মোহাম্মাদ আলীকে অসুস্থ করেছে। এরজন্য অবশ্য অনেকেই কারণ হিসেবে দাড় করান, যেহেতু তিনি ১৯৬৪ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন, তাই বিশেষ ঔষধ প্রয়োগে তার ব্রেইনকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়। কিন্তু সেটা আমার মনে হয় না। কারণ ঐ ঘটনার পর আরো প্রায় ২ যুগ সে তার ক্যারিয়ার রান করে এবং বড় বড় খেলায় জয়লাভ করে। 
.
আমার মনে হয়, যখন সে মূল ইসলামের দিকে অর্থাৎ কাদিয়ানী টাইপ ধর্ম ত্যাগ করে ১৯৭৫ সালে মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসে তখনই সে সিআইএ’র শত্রুতে পরিণত হয়। আর সেই ধারবাহিকতায় ১৯৮০ সালে পারকিনসনে তার ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে।
মূলত কর্পোরেট ইহুদীরা সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করে সেলিব্রেটির মাধ্যমে। তারাই বিভিন্ন সময় সেলিব্রেটিদের উত্থ্যান ঘটায় এবং ঐ সিলেব্রেটিরা যা করে সাধারণ মানুষ অন্ধের মত তাদেরকেই অনুসরণ করে, এভাবেই সারা বিশ্বকে নাচায় ইহুদীরা। কিন্তু সেই সেলিব্রেটিরা যখন ইহুদীদের মূল ট্র্যাক থেকে সরে যায়, তখন বাধ্য হয়ে তাদেরকে হত্যা ও অথবা অসুস্থ করতে বাধ্য হয় তারা। যেমন মাইকেল জ্যাকসন কিংবা প্রিন্সেস ডায়ানা, তারাও ইসলাম গ্রহন করার পর তাদের কৌশলে হত্যা করা হয়েছিলো।

মূলত ইহুদীরা চেয়েছিলো মোহাম্মাদ আলী যেন কাদিয়ানী টাইপ ধর্ম গ্রহণ করে ঐ গোত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, কারণ কাদিয়ানী টাইপ ধর্মগুলোর জন্মদাতাও খোদ ইহুদীরাই। কিন্তু যখনই মোহাম্মদ আলী সেই রাস্তা থেকে সরে এসে মূল ধারার ইসলামে যোগদান করলো, তখনই তাকে কৌশলে শেষ করে দেওয়া হলো। কারণ মারাত্মক জনপ্রিয় মোহাম্মাদ আলীকে অনুসরণ করে অনেকেই কনভার্ট হয়ে মূল ধারারা ইসলামে সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে।

যাই হোক বহুদিন দুরারোগ্য রোগে ভোগার পর অবশেষে শুক্রবার রাতে বিদায় নিলেন কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলী। বিদায় মোহাম্মদ আলী...........
"আমি সবসময় আমার কাছে দিয়াশলাই রাখি।যখনই কোন ভুল বা পাপ করে ফেলি তখন দিয়াশলাই জ্বেলে আগুনে হাত দিই। আর নিজেকে বলি, তুমি সামান্য একটা দিয়াশলাই এর আগুন সহ্য করতে পারো না; তাহলে জাহান্নামের আগুন কিভাবে সহ্য করবে?"
-মোহাম্মদ আলী
.
"This life is not real. I conquered the world and it did not bring me satisfaction. God gave me this illness to remind me that I'm not number one, He is..... I know where I'm going and I know the truth, and I don't have to be what you want me to be. I'm free to be what I want."
- Muhammad Ali

(‘আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করতে পারব না, মুষ্টিযুদ্ধের খাতিরেও নয়।’
-মোহাম্মদ আলী 
আমি চিকাগোতে একটিম বাস কিনেছিলাম; সেই বাসে করে সোজাসুজি লাসভিলে যাই। সেখানে ছিলেন আমার পরিচিত একজন নকশাশিল্পী, আমার পিতা। তিনি একপাশে লিখেছিলেন কমলা-সবুজ-লাল-হলুদ এবং নীল, অবশ্য বেশির ভাগ লাল রঙে: ‘আকর্ষণীয় যোদ্ধা: কেসিয়াস ক্লে’। আর একপাশে লেখা ছিল: ‘সোনি লিস্টন সেরা যোদ্ধা, কিন্তু তিনি ধরাশায়ী হবেন অষ্টম রাউন্ডে।’ আমি একে বলেছি বিশাল লাল।

দুপাশে ঘুরেছি। ঘুরেছি সারা দেশ। আবৃত্তি করেছি কবিতার মতো, লিস্টনের পতন হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছি। খেতাবি লড়াইয়ের জন্য এমন জোরদার প্রচার অভিযান চালিয়েছি, তেমন জোরদার প্রচার অভিযান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও খুব কম প্রার্থীই করেন। প্রচার অভিযানে আমার প্রিয় স্লোগান ছিল ‘ক্লের মুষ্টি’।
গত ছয় মাসে প্রতি পদক্ষেপে আমি লিস্টনকে পরাভূত করেছি। চ্যালেঞ্জ করেছি, ভবিষ্যদ্বাণী করেছি তার (সনি লিস্টন) পতনের, অভিহিত করেছি তাকে বিকট কদাকার ভালুক বলে, যার ফলে তার কিংবা সংবাদপত্রের পক্ষে আমাকে উপেক্ষা করা অসাধ্য হয়ে ওঠে। এক কথায়, আমার সমস্ত প্রচার অভিযানে আমাকে খেতাবি লড়াই দানের জন্য প্রমোটরদের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলাম।
কেবল তা-ই নয়, এই অভিযানে নতুন কিছু পেয়েছিলাম, যার মূল্য আমার কাছে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদার থেকেও বেশি ছিল। এখন আমার যে অনুভূতি হয়, তা আমার জীবনের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। যখন ড্রেসিং রুমে অ্যাঞ্জেলো ভয়ংকর দৃষ্টি মেলে বলেছিলেন, ‘সেখানে কে আছে তুমি কি জান?’ তিনি দরজা অর্ধেক খুলে রিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যালকম এক্সের (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নেতা) দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। দৃষ্টি ছিল তাঁর মুষ্টিযুদ্ধের পুরোনো পোস্টারের দিকে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি বুঝতে পারছ যদি সংবাদপত্র এ ঘটনা তুলে ধরে তবে কী হবে? তারা তোমাকে ধিক্কৃত করবে, তোমার নিন্দা করবে, এ লড়াইকে নস্যাৎ করে দেবে।’ ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে বলেছিলেন, ‘তুমি দয়া করে তাকে এখান থেকে সরিয়ে দাও। সংবাদপত্র যদি জানতে পারে তুমি ম্যালকম এক্সের মতো মুসলমানদের সঙ্গে জড়িত আছ, তবে তোমার ভবিষ্যৎ নস্যাৎ হয়ে যাবে।’ ‘তুমি কি বুঝতে পারছ?’ তার কণ্ঠে প্রশ্ন।
স্মৃতির পাতায় মোহাম্মদ আলী

এখন পর্যন্ত আমি একজন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে যতখানি ঘনিষ্ঠ, ঠিক ততখানি ঘনিষ্ঠ আছি অ্যাঞ্জেলোর সঙ্গেও। তিনি কেবল জানতেন না ম্যালকম একমাত্র এক্স নয়, আমিও কেসিয়াস এক্স। আমি নিজেও মহামান্য এলিজা মোহাম্মদের (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নেতা) অনুসারী। অ্যাঞ্জেলো মনে করেছিলেন তিনি কোনো রেখাপাত করতে পারছেন না। আর তাই আকস্মিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করলেন। আমি পরে জেনেছি, তিনি তাঁর ভাই ক্রিসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং ক্রিস সঙ্গে সঙ্গে প্রমোটর বিল ম্যাকডোনাল্ডকে খবর দিয়েছিলেন। এই ম্যাকডোনাল্ডই হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন, যে সমাবেশ মুষ্টিযুদ্ধের ইতিহাসের বৃহত্তম হেভিওয়েট খেতাবি লড়াই বলে পরিগণিত হয়েছে।
ক্রিস আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন: কেসিয়াস, তোমার কি এক মিনিট সময় হবে? ম্যাকডোনাল্ড তোমাকে তাঁর অফিসে যেতে বলেছেন।
কী ব্যাপার গুন্ডাজি? আমি তাকে প্রশ্ন করি। যদিও ক্রিস এবং অ্যাঞ্জেলো আমার বন্ধু ও প্রশিক্ষক, তবু আমি রসিকতা করে ক্রিসকে গুন্ডাজি বলে সম্বোধন করি। এর মূল কারণ এই যে ক্রিসের মুষ্টিযুদ্ধের সোনালি দিনগুলোতে ছিল দুর্বৃত্তদের আধিপত্য।
ক্রিস খুব আস্তে আস্তে বললেন, এক মিনিটের বেশি লাগবে না। ভাবখানা এই যে তিনি কেবল আমাকে জানাতেই এসেছিলেন।
আমি কাপড় পরে নিই এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্রিস ও আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটন স্ট্রিট ধরে কনভেনশন হলে ম্যাকডোনাল্ডের অফিসে হাজির হলাম। তখন ছিল সূর্যস্নাত দিন। রাস্তায় অনেকেই আমাকে থামিয়ে অটোগ্রাফ নিয়েছেন, লিস্টন সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন অথবা শুভকামনা করে বলেছেন, ‘জয় হোক তোমার।’ তখন ক্রিস ঘড়ি দেখছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘ম্যাকডোনাল্ড অপেক্ষা করছেন।’
অফিসে পৌঁছে আমার ভাইকে ঠেলে দিই আগে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ক্রিস তাকে থামিয়ে বললেন, ‘ম্যাকডোনাল্ড তোমাকে চায়, তোমার ভাইকে নয়।’ আমি ইতস্তত করি, ভাবতে থাকি, এমন কী ব্যাপার যা আমার ছোট ভাই শুনতে পারবে না? কিন্তু রুডি একপাশে সরে গিয়ে বিনীতভাবে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি বাইরেই অপেক্ষা করি।’ ক্রিস ও আমি অগত্যা প্রমোটরের অফিসে প্রবেশ করলাম।
ম্যাকডোনাল্ড একজন দীর্ঘদেহী মানুষ। তার চুল বাদামি রঙের আর মুখ বড় ও লালচে আকৃতির। তিনি ক্রিসকে বললেন দরজা বন্ধ করে দিতে। তারপর আমার দিকে দৃষ্টি মেলে ক্রিসের দেওয়া একটা মোটা সিগার ধরাতে ধরাতে আমাকে বললেন, ‘কেসিয়াস, সপ্তাহ খানেক আগে কি তুমি সত্যিই নিউইয়র্কে গিয়ে নিউইয়র্ক ইসলাম জাতির মসজিদে উঠেছিলে? তোমাকে কি প্রকাশ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল? তুমি কি সারা দিন সেখানে কাটিয়েছিলে এবং সাংবাদিকদের, যাঁরা তাদের সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তুমি কি তাদের পক্ষে (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম) কথা বলেছিলে?’
‘সবকিছুই সত্যি।’ আমি জবাব দিই।
ম্যাকডোনাল্ড তাঁর চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তখন তাঁকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। কণ্ঠস্বর দৃঢ়। তখন থেকে তিনি বাদীপক্ষের উকিলের মতো আসামির দণ্ডাদেশকে যেকোনো পন্থায় ন্যায়সংগত প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে লাগলেন। বাদীপক্ষের উকিলের মতোই তিনি বললেন, ‘ম্যালকম এক্স কি তোমার আমন্ত্রণেই এখানকার জিমনেসিয়ামে এসেছিলেন?’
আমি তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তাঁর চোখেমুখে আশঙ্কা ফুঠে উঠল।
ম্যাকডোনাল্ড জেরা অব্যাহত রেখে বললেন, ‘আমি এ কথাও জানতে পেরেছি, তোমার ক্যাম্পে তোমার উদ্যোক্তার পয়সায় ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী এবং একজন মুসলমান নারী রাঁধুনি নিয়োগ করেছ, এ সবই কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’ আমার জবাব।
ম্যাকডোনাল্ডের জেরা—‘তুমি কি জান, যখন থেকে জানাজানি হয়েছে ম্যালকম এক্স তোমার ক্যাম্পে এসেছেন, তখন থেকে রটেছে যে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানরা তোমাকে প্রভাবিত করেছে? ইতিমধ্যে এ লড়াই বিপর্যস্ত হয়েছে। আমার মুনাফা ফিরে পাওয়ার এখনো সুযোগ আছে এবং তার একটিমাত্র উপায়। তোমাকে আজ এখনই ঘর পরিষ্কার করতে হবে। প্রথমেই তোমার মুসলিম রাঁধুনিকে বাদ দিতে হবে, বাদ দিতে হবে নিরাপত্তা প্রহরীদের, ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল এবং অন্যদের। তারপর আজ রাতেই বেতার ও টেলিভিশনে ঘোষণা করতে হবে যে তোমার সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাকে গণসংযোগের কাজের জন্য লোক দেব। তোমাকে বলতে হবে, তোমার সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। যা কিছু বলা হয়েছে সবকিছুই ভুল। তোমাকে ঘোষণা করতে হবে তুমি নির্দোষ বলে। তাহলেই আমরা কাজে এগিয়ে যেতে পারি।’ তিনি ফোন তুলে ডায়াল শুরু করলেন।
আমার প্রশ্ন—‘এবং যদি তা না করি?’
তিনি আমার দিকে চোখ তুললেন। আস্তে আস্তে ফোন রেখে দিলেন।
তিনি গম্ভীর হয়ে উঠলেন। চোখেমুখে কোনো ভাওতাবাজির চিহ্ন নেই। বললেন, ‘তুমি যদি না পার, তাহলে এ লড়াই হবে না। আমি স্থগিত রাখছি। তোমার জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি কাণ্ডজ্ঞানহীন নও। তুমি সারাটা জীবন ধরে যা চেয়েছ, তা মাটি করে দিতে পার না। এখনো শেষরক্ষার সময় আছে। আমি তোমাকে বলেছি, আমার গণসংযোগ বিভাগের লোক তোমাকে সাহায্য করবে। আজ সন্ধ্যায় তুমি টিভিতে যাও, তুমি বিশ্বকে জানিয়ে দাও যে তুমি কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের কেউ নও। কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না। বলো, তোমার সম্পর্কে ভুল ধারণা করা হয়েছে। বলে দাও, তুমি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক অনুগত মার্কিন নাগরিক। তুমি সব সময় তাই ছিলে এবং থাকবেও। তবে এমন হতে পারে, তুমি ভালোভাবে না জেনে কোনো কিছুতে সইটই করেছ। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা সংবাদ সম্মেলন ডাকব, সবকিছু পরিষ্কার করে দেব। আর তাহলেই লড়াই যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে, এখনো যা জুয়াখেলার মতো হয়ে রয়েছে। কিন্তু ওই শর্তে লড়াই অনুষ্ঠিত হতে পারে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, তাঁর দিকে তাকালাম। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না আমি তা পারব না। শিরোপা লড়াইয়ের জন্য লিস্টনের মুখোমুখি হওয়ার যে সুযোগ আপনি দিয়েছেন, তার জন্য আমি কতৃজ্ঞ। আমি জানি লিস্টনকে আমি হারাতে পারব, আর তাই আমি চাই না লড়াই বন্ধ হয়ে যাক। কিন্তু আমার বিশ্বাসের জন্য যদি আপনাকে এ লড়াই স্থগিত রাখতে হয়, তবে তাই হোক।
ক্রিস উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘আমরা কেন এসব কিছু ভুলতে পারি না? লড়াইটা না হওয়া পর্যন্ত সবকিছুই ভুলতে হবে।’
ম্যাকডোনাল্ড চূড়ান্তভাবেই বললেন, ‘না, লড়াই হতে পারে না।’ তিনি ফোন তুলে রিং করলেন, বলে দিলেন, ‘এ লড়াই হবে না। সংবাদপত্রকে বলে দিন, সবাইকে জানিয়ে দিন এ লড়াই হবে না।’
তিনি ফোন ধরে থাকতে থাকতেই আমি দরজার কাছে চলে এলাম।
ক্রিস আমাকে ধরে রাখলেন। যেতে নিষেধ করলেন। আমি প্রোমোটরের মুখের দিক তাকালাম। আমি জানি তিনি কিংবা আমি কেউই মিথ্যা কথা বলছি না। আমার মাথা এমন ঝিমঝিম করছিল যে আমি আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সোজা জিমনেসিয়ামে চলে আসা পর্যন্ত কোনো কিছু বলতে পারিনি। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মিয়ামিতে বাসায় চলে এলাম গাড়ি চালিয়ে।
আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম ম্যাকডোনাল্ড সত্যিই লড়াই বন্ধ করে দিতে চান। তিনি যা বলেছেন, সবকিছুই অর্থবোধক। কিন্তু আমি বাড়িতে আসতে না আসতেই ফোন বেজে উঠল। লাসভিলের একজন উদ্যোক্তা ওয়ার্থ বিংহাম ফোন করেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন লড়াই হবে না।
‘শোন কেসিয়াস’, তিনি বললেন—‘তোমার দিককার ঘটনা আমি জানি, কিন্তু তুমি যা-ই কর না কেন, লড়াই বন্ধ হতে দিও না। ম্যাক তোমাকে কী করতে বলেন?’
আমি বলি, ‘তিনি আমাকে আমার ধর্ম অস্বীকার করতে বলেছেন এবং তার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে।’
‘তবে তাই করো। কাজে নেমে পড়ো, তোমার তাতে ক্ষতি কী? তোমাকে এ ধরনের সুযোগ তারা আর দেবে না। ম্যাকডোনাল্ড এ লড়াই বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাকে তুমি কোনো সুযোগ দিও না।’
আমার জবাব, ‘আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করতে পারব না, মুষ্টিযুদ্ধের খাতিরেও নয়।’
‘তুমি আমার কথা শোনো, তোমার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু তুমি যদি লড়াইয়ে জিতে যাও, তবে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তুমি আমার উপদেশ যদি চাও, আমি বলব যে ম্যাকডোনাল্ড যা বলেন তুমি তা করো। তিনি সরে যাওয়ার সুযোগ খঁুজছেন। তুমি তাঁকে সেই সুযোগ দিচ্ছ, কিন্তু তা দিও না। তাঁর পায়ের তলার মাটি তুমি কেড়ে নাও। জনসাধারণের সামনে তোমার ভাবমূর্তি তোমার ধর্ম নয়। তোমার মনে ঈশ্বর বৈ আর কী আছে তা কে জানবে? আমি তোমার আল্লাহর কথাই বলছি। তোমার ধর্মান্তর মাত্র কয়েক মাসের ঘটনা। আল্লাহ তা জানেন।’ এ কথা বলেই বিংহাম ফোন ছেড়ে দিলেন।
আমি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। কয়েক বছর পরে....আমি যখন এই মুহূর্তের কথা চিন্তা করি, আমি অনুভব করার চেষ্টা করি তখন আমার মনের অবস্থা কী ছিল। আমার মনে পড়ে, আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমার ‘কয়েক মাসের ধর্মান্তরের’ ঘটনাকে তারা যা ভাবত, মুসলমান জাতির কাছে তার তাৎপর্য ছিল তার থেকেও বেশি। আমি চেয়েছিলাম দাসত্বের নাগপাশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণের মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সমানাধিকার। এ কথা আমি আমার লাসভিল উদ্যোক্তা কিংবা ম্যাকডোনাল্ডকে কখনো বোঝাতে পারব না।
আমার সহযোগীদের অনেকেই ফোনে আমার কথাবার্তা শুনেছিল, তারা বুঝেছিল আমি কিসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। বান্দিনী (মহিলা রাঁধুনি) তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কী করবেন, চ্যাম্পিয়ন?’
আমি বললাম, আমরা চলে যাচ্ছি। চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই হবে না। বাক্স-প্যাটরা গোছাতে হবে।
‘বাড়ি যাওয়ার অর্থ কী?’
আমি বললাম, তোমরা কোনো টাকাপয়সা পাবে না।
সে বলল, ‘রসিকতা কর আর যাই কর, আমি টাকাপয়সা পাই আর না পাই, আমি চ্যাম্পিয়নের সঙ্গেই থাকব। স্যুটকেস গুছিয়ে নিই, রাস্তায় লড়াই দেখা যাবে।’
আমার কর্মচারীরা বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে বাসে গিয়ে উঠল।
আমি মাকে বললাম, লড়াই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে আসছি। আমি তার গলা শুনে বুঝলাম, তিনি ভেঙে পড়েছেন। আমাদের সবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন যেন ভেঙে গেছে। আমার মুষ্টিযুদ্ধের জিনিসপত্র বোঝাই একটা বড় ভারী বাক্স নিয়ে যেতে আমি বান্দিনীকে সাহায্য করলাম। আমি ইঞ্জিনের কাছে বসলাম, চিন্তা করতে লাগলাম ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হলো।
.....................
মোহাম্মদ আলী: সদ্যপ্রয়াত বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা।
.....................
বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা একটি ক্রোড়পত্র বের করেছিল। সেখানে মোহাম্মদ আলীর নিজের একটি লেখা ছাপা হয়েছিল, শিরোনাম, ‘আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করি না।’)

কবি হিসাবেও খারাপ ছিলেন না মহম্মদ আলি। ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতেন। ১৯৬৩ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে নিজের লেখা কবিতা ও লেখা অ্যালবামের মতো করে রেকর্ড করেন তিনি।
১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ বক্সিং হেভিওয়েট চ্য়াম্পিয়ন হন আলি। ১৯৯৯ সালে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটের বিচারে শতাব্দির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন মহম্মদ আলি। বিবিসির বিচারে তিন হন শতাব্দির সেরা খেল-ব্যক্তিত্ব।

Comments