কাহলিল জিবরান - আবু এন এম ওয়াহিদ

কাহলিল জিবরান

আবু এন এম ওয়াহিদ


কোনো এক দ্বীপদেশের এক অগ্রগামী অগ্রদূত, দেশ ছেড়ে অনেক দূরে প্রবাসে থাকেন, স্বপ্ননগরী ওরফালেসে। অগ্রদূত একজন মহাপুরুষ। তিনি তার প্রভুর প্রিয়পাত্র এবং সঠিক সত্যপথের অনুসারী। তার নাম আল মুস্তাফা। আল মুস্তাফা, ওরফালেসে এসে যখন সত্য প্রচার শুরু করেন, তখন যে ব্যক্তি প্রথম তার কথায় আস্থা রেখে তার
ভক্ত অনুসারী হলেন, তিনি একজন নারী। তার নাম আল মিত্রা। প্রবাসজীবনে আল মুস্তাফা, ওরফালেস মহানগরে সাধারণ মানুষদের সাথে অতি সাধারণ জীবন যাপন করেন। তাদের সুখ-দুঃখ নিজের সাথে ভাগাভাগি করে নেন, সময় সময় তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দেন এবং এভাবে অল্প দিনেই তিনি অসংখ্য গণমানুষের হৃদয়ে নিজের স্থান চিরস্থায়ী করে নেন। 
ওরফালেসে ১২ বছর বসবাসের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্ মুস্তাফা যেদিন জাহাজে উঠতে যাবেন, সেদিন তার অনুসারী লাখ লাখ নগরবাসী তাকে বিদায় জানাতে দলে দলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত সাগরপারের ধর্মশালার সামনে জনমানুষের জমায়েত রূপ নেয় এক জনসমুদ্রে। বিদায় বেলায় প্রাণপুরুষকে কাছে পেয়ে নগরবাসী একে একে উত্থাপন করে রহস্যময় জীবন-জিজ্ঞাসার নানা প্রসঙ্গ। আর তিনি উদাহরণ ও গল্পের ছলে তাদেরকে বোঝান অর্থপূর্ণ মানবজীবনের বিভিন্ন দিক। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে ভালোবাসা ও ঘরসংসারের কথা। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম, ছেলেমেয়ে, খাওয়া-পরার কথা। সমাজ, ন্যায়-অন্যায়, আইনকানুন, বিচার-সালিসের কথা। সৌন্দর্য, আনন্দ, জীবন-মৃত্যু, ধর্ম ও প্রভুর কথা। আলোচনা শেষে আল মুস্তাফা ধীরে ধীরে গিয়ে জাহাজে ওঠেন। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ জনতার মুখোমুখি হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে উঁচুস্বরে তিনি তার বিদায়বেলার শেষ বক্তব্য রাখতে থাকেন। জাহাজ আস্তে আস্তে সমুদ্রতীর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আল মুস্তাফার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে আসে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে। ততক্ষণে ওরফালেসবাসী যার যার বাড়িঘরে ফিরে গেছেন। আল মিত্রা একা দাঁড়িয়ে আছেন সাগরপারে। তিনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন সীমাহীন জলরাশির দিকে। তারই অশ্রুবাষ্পে আবছা হয়ে যাওয়া জাহাজ ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে দিগন্তরেখার সাথে মিলিয়ে যায়! আল মিত্রা ভাবতে থাকেন আল মুস্তাফার কথা- ‘কে তিনি? কেন এলেন? কেন ফিরে গেলেন? আর কোথায়ই বা তার দেশ?’
এ কাহিনী বর্ণিত আছে, বিখ্যাত ‘দি প্রফেট’ গ্রন্থে। এতে আছে ২৬টি কাব্যিক প্রবন্ধ। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯২৩ সালে, কিন্তু এটা প্রথমবারের মতো আমেরিকার কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অনেক পরে, ১৯৬০-এর দশকে। তারপর দুনিয়াব্যাপী বইটির চাহিদা এতই বেড়ে যায় যে, আজ অবধি পৃথিবীর ৪০টি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। বইটি কখনোই ‘আউট অব প্রিন্ট’ হয়নি। এই বইয়ের লেখক একজন প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন মানবসভ্যতাকে তার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সব কিছু উজাড় করে দিয়ে যেতে এবং দিয়েও গেছেন। প্রতিদানে তিনি কিছুই চাননি, পাননি, নেনওনি। উপরন্তু তার অফুরন্ত সেই ভাণ্ডার শেষ হওয়ার আগেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে! তিনি আর কেউ নন। চিন্তাবিদ, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, ও কবি কাহ্লিল জিবরান। 
কাহলিল জিবরান ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান লেবাননে অবস্থিত বিশাররি নামক পাহাড়ি পল্লীতে এক ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল খলিল জিবরান। তিনি নিজের নামেই ছেলের নাম রেখেছিলেন, খলিল জিবরান, সে নাম কী করে ‘কাহলিল জিবরান’ হলো সে কথায় ফিরে আসব পরে। জিবরানের মায়ের নাম ছিল কামিলা রাহমাহ। কামিলার বাবা ছিলেন একজন পাদ্রি। জিবরান তার মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। জিবরানের বাবা ছিলেন তার মায়ের তৃতীয় স্বামী। মূলত অভাব-অনটনের কারণে ছোটবেলায় জিবরানের স্কুলে যাওয়া হয়নি। একা একা তিনি পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গভীরভাবে অবলোকন ও উপভোগ করতেন! পরবর্তীকালে তার লেখায় এবং ছবি আঁকায়, পাহাড়, পর্বত ও প্রকৃতির প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। জিবরানের মা কামিলা ছিলেন রক্ষণশীল খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে। তাই তাদের বাড়িতে ধর্মশিক্ষাদানের জন্য ঘন ঘন একজন পাদ্রির আনাগোনা ছিল। ওই পাদ্রির কাছে ভাসা ভাসাভাবে, জিবরান বাইবেলের সাথে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও আরবি ভাষা শেখেন। দুষ্টু জিবরান দশ বছর বয়সে খাড়া পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড়ের বাঁ দিকে মারাত্মক জখম করে ফেলেন। সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে আর কোনোদিন তার ঘাড়ের বাম দিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। 
জিবরানের বাবা প্রথম দিকে এক ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন। তার জীবন ছিল খুবই ছন্নছাড়া ও অগোছালো। তিনি জুয়া খেলায় আসক্ত ছিলেন, যে কারণে সব সময় থাকতেন ঋণগ্রস্ত। পরে তিনি এক অটোম্যান আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তার অধীনে কাজ নিয়েছিলেন। লেবানন তখন ছিল সিরিয়ার অঙ্গীভূত; আর সিরিয়া ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ। জিবরানের জন্মের সময় তার মায়ের বয়স ছিল ৩০। জিবরানের বয়স যখন মাত্র আট, তখন কর ফাঁকির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তার বাবাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ওই মামলায় তার সমস্ত সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ফলে কামিলা জিবরান, জিবরানের সৎভাই পিটার এবং দুই বোন মারিয়ানা ও সুলতানাকে নিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। কামিলা ঘুরেফিরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। তখন জিবরানের এক মামা থাকতেন আমেরিকায়। ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে ভাগ্য বদলের আশায় অনেক সাহস করে, কামিলা ১৮৯৫ সালের ২৫ জুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাজযোগে বৈরুত থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার কিছু দিন আগে জিবরানের বাবা জেল থেকে ছাড়া পান বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তিনি পরিবারের সাথে আমেরিকা না এসে লেবাননেই থেকে যান।
জিবরানের মা আমেরিকাতে এসে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ঐতিহাসিক বোস্টন শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বসতি স্থাপন করেন। ওই সময় দক্ষিণ বোস্টনে জিবরানের মামাসহ আরবিভাষী অনেক সিরিয়ান ও লেবানিজ লোক থাকতেন। অন্য সিরিয়ান মহিলাদের সাথে জিবরানের মা এক পোশাক তৈরির কারখানায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেইস ও লিনেন দ্রব্যাদি বিক্রি করতে থাকেন। আমেরিকা আসার দুই মাস পর ১৮৯৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ‘খলিল জিবরান’ গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। সে সময় ভুলবশত স্কুলের রেজিস্ট্রি বইয়ে তার নাম কযধষরষ ঔরনৎধহ-এর বদলে কধযষরষ ঔরনৎধহ লেখা হলো। এভাবে তার বাবার দেয়া আসল নাম বিকৃত হয়ে গেল এবং জিবরানও পরে আর সে নাম শোধরানোর কোনো তাগিদ অনুভব করেননি।
যেহেতু তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার কোনো রেকর্ড ছিল না, তাই অন্যান্য সব অভিবাসী ছেলেমেয়ের সাথে ইংরেজি শেখার জন্য তাকে একটি বিশেষ ক্লাসে ভর্তি করা হলো। ছোটবেলা থেকেই জিবরান নিখুঁত ছবি আঁকতে পারতেন। তার এই বিরল প্রতিভা অচিরেই শিক্ষকদের নজর কাড়ে। স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় জিবরানের যোগাযোগ হয় তখনকার সময়ে বোস্টনের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ফ্রেড হল্যান্ড ডে-এর সাথে। ফ্রেড ডে জিবরানকে এতই পছন্দ করে ফেলেন, তিনি সাথে সাথে জিবরানের মেন্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জিবরানকে বলতেন ‘ন্যাচার‌্যাল জিনিয়াস’। ফ্রেড ডে-এর উৎসাহে এবং আনুকূল্যে জিবরান বইয়ের কাভার ডিজাইন, স্টোরি ইলাস্ট্রেশন এবং পোট্রেট আঁকার কাজ পেতে থাকলেন। এভাবে ছবি আঁকা ও চিত্রশিল্পের মহাজগতের সিংহদ্বার জিবরানের জন্য অতি সহজেই খুলে গেল! 
জিবরানের সৃষ্টিশীল বোস্টন-জীবনের শুরুতেই হঠাৎ একটা ছেদ পড়ে যায়। কী মনে করে বিশুদ্ধ আরবি শেখার জন্য তিনি ১৮৯৮ সালে ১৫ বছর বয়সে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ফিরে গিয়ে ভর্তি হন ‘মাদরাসাতুল হিকমায়’। সেখানে আরো কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় আরবি ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। চার বছর পর বোস্টনে ফিরে আসেন ১৯০২ সালের ১০ মে। তার দুই সপ্তাহ আগে, তার বোন সুলতানা ১৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। পরের বছর তার ভাই পিটারও মারা যান একই রোগে। একই বছর জিবরানের মাও মারা যান ক্যান্সারে। (লক্ষ করার বিষয়, এখানে আরবি কবি জিবরানের জীবনের সাথে রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।) তারপর তার বোন মারিয়ানা সেলাইয়ের কাজ করে তাদের দু’জনের সংসার চালাতেন। বৈরুত থেকে ফিরে এসে জিবরান, ফ্রেড ডে-এর সাথে পুরো উদ্যমে পেইন্টিংয়ের কাজ আবার শুরু করেন। ১৯০৪ সালে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী (ঙভ ঈযধৎপড়ধষ উৎধরিহমং) হয় বোস্টনে, ফ্রেড ডে-এর স্টুডিওতে। এরপরই চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে জিবরানের নাম-ডাক। এ প্রদর্শনীতে জিবরানের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয় মেরি এলিজাবেথ হ্যাস্কেলের। মেরি হ্যাস্কেল ছিলেন স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মেরির সাথে অচিরেই গড়ে ওঠে জিবরানের বন্ধুত্ব। মেরির আগ্রহে এক সময় এই সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়, তবে প্রেম ছিল অনেকটা একতরফা। মেরি বিভিন্ন সময় জিবরানকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। কিন্তু বারবার জিবরান তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে, ‘আমি বিবাহযোগ্য নই।’ তথাপি, মেরি হ্যাস্কেল নিজের টাকায় জিবরানকে দুই বছরের জন্য প্যারিস পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী, অগস্ত রোদ্যাঁ-এর (১৮৪০-১৯১৭) সাথে থেকে আর্ট শেখার জন্য। জিবরানের শিল্পীজীবন ও তার সফলতার ওপর মেরি হ্যাস্কেলের অবদান ও প্রভাব খুবই বেশি। জিবরানের প্রতি মেরির প্রেম পরিণতি না পেলেও তাদের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব নিখুঁতভাবেই বহাল ছিল জিবরানের মৃত্যু পর্যন্ত। 
জিবরানের প্রথম দিককার লেখা সবই আরবিতে। ইংরেজিতে তার প্রথম বই ‘দি ম্যাড ম্যান’ বের হয় ১৯১৮ সালে। ১৯২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে ‘সোসাইটি ফর অ্যারাব রাইটারস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম বের হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি প্রফেট’। জিবরানের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘স্যান্ড অ্যান্ড ফোম’, ‘জেসাস, দি সান অব ম্যান’ ইত্যাদি। 
১৯১২ সাল থেকে জিবরান বোস্টন ছেড়ে নিউ ইয়র্ক শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। ১৯৩১-এর ১০ এপ্রিল লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কেই তার জীবনাবসান ঘটে। জিবরানের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার লাশ লেবাননের বিশাররি-এর নিভৃত পল্লীতে নিয়ে সমাহিত করা হয়। জিবরানের কথা মতো, তার এপিটাফে লেখা আছে, 'A word I want to see written on my grave : I am alive like you, and I am standing beside you. Close your eyes and look around, you will see me in front of you.'

Comments