আঁচড় - স্বাধীন পারভেজ


  আঁচড়   

স্বাধীন পারভেজ

সাজেদা কিছুতেই ভেবে পায় না এই সামান্য ব্যাপারটাকে নিয়ে বাবলু হঠাৎ এত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল কী কারণে? এ বাসাটা খুব পুরনো। স্বল্পসময়ের নোটিশে হঠাৎ ফ্ল্যাট ছেড়ে দেয়ার কারণে খুব খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিল ওরা। এত অল্প সময়ের মধ্যে কোথাও কোনো ভালো ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম বাধ্য হয়েই এ পুরনো বিল্ডিংয়ে এসে উঠেছিল তারা।
এখানকার ঘরগুলোর দেয়াল কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে, রুমগুলোও বেশ অন্ধকার, আর মেঝেটাও টাইলস করা নয়। অগত্যা তারা দুজনে  মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ বাসাতে স্থায়ী হবে না। স্রেফ বসবাস উপযোগী নতুন একটা সুন্দর ফ্ল্যাট খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো মতে থেকে যাবে আর কি!
ফ্ল্যাটে ওঠার দিন দশেক পরের কথা, এক বিকেলে একলা একা শূন্য ঘরে বসে বসে টিভি দেখছিল সাজেদা। হঠাৎ কোত্থেকে ইয়া বড় এক মাজড়া পোকা উড়ে এসে আচমকা কামড় বসিয়ে দেয় ওর কাঁধে। বিরক্ত সাজেদা ডেটল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিয়েছিল তখনই। সন্ধ্যার পরে ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বিষয়টা আর খেয়ালই ছিল না তার। কিন্তু অফিস শেষে বাসায় ফিরে সাজেদার কাঁধের ওই আঁচড়টি দেখেই ভয়ানক চটে যায় বাবলু! যা দেখে রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় বনে যায় সাজেদা। না, বাবলুর এই বিচলিত হওয়াটা একটা হতভাগা পোকার কামড়ে বউয়ের আহত হওয়ার কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে নয় মোটেও; বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা চলে বেশ মারমুখী ভঙ্গিতে স্ত্রীকে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল সে কাঁধের আঁচড়ের দাগটা এলো কোথা থেকেসাজেদা যতই বলছিল যে এটা শুধুই একটা পোকার কামড়, ততবারই ক্ষেপে যাচ্ছিল বাবলু। বারবার একই প্রশ্নোত্তর, একই কথা ঘুরতে থাকায় বিরক্ত হয়ে একসময় পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল সাজেদা। সে কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছিল না যে, এইটুকু ব্যাপার নিয়ে তার স্বামী হঠাৎ এত ক্ষেপে উঠল কেন? পোকার ওই সামান্য আঁচড়ে তো তার শরীরের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়নি। আঁচড়টা তার চেহারাতেও লাগেনি যে বউয়ের সৌন্দর্যহানির আশঙ্কায় স্বামী তাকে দুষবেন। তা ছাড়া বাবলুর বাচনভঙ্গিতে সমবেদনার কোনো চিহ্নমাত্র নেই। বরং সাজেদাকে সে পুরোপুরি অভিযুক্তের মতোই ধমকাচ্ছিল। এ রকম একটা মামুলি ব্যাপারে মানুষটার এমন অগ্নিমূর্তি ধারণের কারণটা কী? দূর! সাজেদা বুঝেই উঠতে পারে না। অন্য দিকে বাবলু তখন বসার ঘরে সোফার ওপর হাত-পা ছেড়ে দিয়ে জ্বরাগ্রস্ত রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। মনের মধ্যে তার হাজারো চিন্তার ছুটোছুটি। এত চালাক সে, এত মেধাবী তার মস্তিষ্ক! নিজের বুদ্ধির ওপর এতটাই দৃঢ় আস্থা ছিল তার; ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাটুকুও করেনি সে কোনো দিন। অথচ এ অবেলায়, বিয়ের দেড় বছরের মাথায় এ কেমন দোটানায় পড়ে গেল সেআসলে আজ ঠিক কী হয়েছে এ বাসায়কিছু কি হয়েছে আদৌনাকি কোনো কিছুই হতে আর বাদ নেই।
সবই করে নিয়েছে সাজেদা!

উফ! বাবলু আর কিছুই ভাবতে পারে না। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে তার। যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলতে থাকে, পুড়তে থাকে প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বিয়ের আগে এবং পরে কতভাবেই না বউকে পরীক্ষা করে নিয়েছিল চতুর বাবলু। নিজের অতীত অভিজ্ঞতার সবটুকু দক্ষতা ঢেলে দিয়ে কৌশলে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল নিজের দাম্পত্য জীবনকে। নির্ঝঞ্ঝাট রেখেও ছিল এতগুলো দিন ধরে। কিন্তু আজ এত দিন পর.... একটি মাত্র আঁচড় কী রকম ভয়ঙ্কর দ্বিধায় ফেলে দিলো তাকে। বুকের ভেতরকার ছাইচাপা আগুন যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, সারাটা গা ঘামতে থাকে তার।
অথচ বাইরে বৃষ্টি, ঝুমবৃষ্টি।
মাত্র দুই বছর আগের কথা। এ রকম কত শত বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যারাতে যে নিজের প্রেমিকা হাসি, তমা, লুবনা বা অন্য কাউকে রিকশা চেপে বাসার তাদের সামনে নামিয়ে দিয়ে এসেছে বাবলু। তারপর হয়তো রাত ৯টা-১০টায় মোবাইলে ফোন করে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে সেই শরীরী নারী- বাবু তোমার বুদ্ধির জবাব নেই!। বাসায় এসেই মাকে বলে দিলাম যে বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, তারই পোষা বেড়ালের আঁচড় লেগেছে আমার কাঁধে। ব্যস, এতেই সবাই চুপ করে গেল। কেউ বুঝতেই পারল না যে এটা শুধুই তোমার মধুর স্মৃতিচিহ্ন! আমার বাবুর আদরের চিহ্ন!
আচ্ছা, এত বুদ্ধি তুমি কোথায় পাও বলো দেখি? আমি তো তা-ই ভেবে পাই না।
প্রেমিকার মুখে নিজের এমন ভরপুর প্রশংসা শুনে মনে মনে বাবলু তখন আরো খানিকটা বাড়তি আত্মতৃপ্তি ভোগ করত!.....

Comments