গোড়াতে হাত দেন, বাকিগুলো নিয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না

আহসান হাবিব -
গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষার ডিউটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকলের প্রবণতা নেই বললেই চলে। এর মধ্যেই কিছুদিন আগে পরীক্ষার সময় আমি একটা মেয়ের নকল ধরেছিলাম। আমাদের স্বাভাবিক চর্চা হল কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করলে তার ব্যাপারে চুপচাপ নির্ধারিত ফরমে রিপোর্ট করা যেন পরীক্ষার হলে অন্যান্য শিক্ষার্থী মনোসংযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথানিয়মে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করে তা সার্কুলেট করে দেন। ব্যতিক্রম ঘটল মেয়েটির ক্ষেত্রে। ঐ মেয়েটি পরীক্ষার হলেই অনেক কান্না শুরু করল। তার কারনেই রুমের অন্যরাও জেনে গেল যে সে নকল করেছে। 


গোড়াতে হাত দেন, বাকিগুলো নিয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না
ভিকারুননেসার একটা মেয়ে আত্নহত্যার পরে ফেসবুকে যেভাবে শিক্ষকের ফাসির দাবি ও ঐ স্কুলের জাত-মান-ঐতিহ্য গেল গেল রব উঠেছে। তা দেখে অনেক দিন পরে এসে আমার সে ঘটনা মনে করে গতকাল থেকে আমি কেমন যেন কিছুট আতংকিত, ভীত সন্ত্রস্তও বলা চলে। যদি সেদিন মেয়েটি বাইরে বের হয়ে আত্নহত্যা করে বসত? তাহলে নিশ্চয়ই আমার ফাঁসির দাবিতে হুজুগে বাঙ্গালী রাস্তায় নেমে পড়ত, ক্যাম্পাসের দেয়াল আর ফেসবুকের ওয়ালে ঠিল্লায় ঠিল্লায় মানবতা উপচে পড়ত, শাহবাগে হয়ত ইন্দুর বিরিয়ানীরও ব্যবস্থা হয়ে যেত। একটা মেয়ে পরীক্ষায় মোবাইল দেখে নকল করেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ শিষ্টাচার মেইন্টেইন করে তার অভিভাবককে স্কুলে ডেকে এনে জানিয়ে দিয়েছে তার মেয়েকে স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী বহিস্কার করে টিসি দিয়ে দেয়া হবে। মেয়ের বাবা পৃথিবীর সকল বাবাদের মতই অনুরোধ করেছে এবারের জন্য মাফ করে দিতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে নিয়মের বাইরে কিছু সম্ভব না। ব্যস! এটাইতো ঘটনা। এটা নিশ্চয়ই কারো জন্য সম্মানের না, অবশ্যই অপমানের। আর এই অবমাননা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্নহত্যা করলে কেন কর্তৃপক্ষকে অপরাধী বানিয়ে তাদের তুলোধুনো করতে হবে? তারপরেও যেহেতু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, বিষয়টির সঠিক তদন্ত দাবি করছি। শিক্ষক কি তার নিজের মোবাইল মেয়েটির টেবিলে রেখে মেয়েটির নামে অভিযোগ করেছিল? নাকি, মেয়েটির ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করেছিল, নাকি নকল করা অবস্থায় মোবাইলটি পেয়েছিল? বাবা’র সাথে আদৌ কোন খারাপ ব্যবহার হয়েছিল কিনা??? প্রত্যেকটা মৃত্যুই দুঃখজনক। বিশেষ করে একজন নবম শ্রেণীতে পড়া কন্যা যখন আত্নহত্যার মাধ্যমে তার সকল সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়, বাবা-মা’য়ের সকল আশা-ভরসা, স্বপ্নকে নিভিয়ে দেয় তা আরো বেশি দুঃখজনক। আজকে যে এই রচনামূলক স্টাটাস লিখলাম বা লিখতে হল এটা নির্লজ্জ ও আদর্শহীন সাংবাদিকতা আর প্রজন্মের অস্থিরতার কারণে। মোটামুটি অধিকাংশ গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো ‘বাবাকে অপমান করায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা’- যমুনা টিভি। ‘পরীক্ষা দিতে না দেওয়ায় ভিকারুননিসা শিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যা’- বাংলা ট্রিবিউন। অপমান সইতে না পেরে ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা- একুশে। অথচ, সংবাদের মূল অংশ পড়েন। মেয়ের বাবার আর স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পড়লেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
আসলে আমরা এমন একটি প্রজন্ম যাদের কোন কিছুর গভীরে যেতে ইচ্ছা করে না। আগে অনেকে চিলে কান নিয়ে গেছে শুনলে চিলের পেছনে দৌড়ানো শুরু করত। আর এখন আগে ফেসবুকে স্টাটাস দেয়, তারপরে সময় পেলে চিলের পেছনে দৌড়ায়। বেকারত্ব, দূর্ণীতি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, কন্ঠরোধ, বাক-স্বাধীনতা হরন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবহন-দূষন-অগণতান্ত্রিক আচরণ-সন্ত্রাস-লুন্ঠন নিয়ে কোন কথা নাই। পাইছে... ‘শিক্ষকের ফাঁসি চাই’।গোড়ায় গন্ডগোল। গোড়াতে হাত দেন, বাকিগুলো নিয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না। স্বাভাবিকভাবেই ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ের বাবার বক্তব্য- ‘অরিত্রির বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। রোববার স্কুলে পরীক্ষার সময় তার মেয়ে মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল। মোবাইলে নকল আছে এমন অভিযোগে ওই স্কুলের শিক্ষক সোমবার তাদের স্কুলে আসতে বলেন। সোমবার পরীক্ষার সময় অরিত্রির সঙ্গে তারা স্কুলে যান। পরে তাদের ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে গেলে তারা মেয়ের নকল করার ব্যাপারে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু ভাইস প্রিন্সিপাল কিছু করার নেই বলে তাদের প্রিন্সিপালের রুমে যেতে বলেন। সেখানে গিয়েও তারা ক্ষমা চান। কিন্তু প্রিন্সিপালও তাতে সদয় হননি। এসময় স্কুল পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যও ছিল। পরে তার মেয়ে প্রিন্সিপালের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও তাদের বেরিয়ে যেতে বলেন এবং পরের দিন টিসি নিয়ে আসতে বলেন। এ সময় আমি মেয়ের সামনেই কেঁদে ফেলি। অরিত্রি হয়তো আমার ওই কান্না-অপমান মেনে নিতে পারেনি।’ শিক্ষকের বক্তব্য- ‘পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। ওই শিক্ষার্থী মোবাইলে পুরো বইয়ের ছবি তুলে নিয়ে এসেছে। এরপর পরীক্ষার হলে দেখে দেখে লেখা শুরু করেছিল। আমাদের কর্তব্যরত শিক্ষক তা দেখে ধরেছেন। কেউ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করলে তাকে বহিষ্কার করা সরকারি নিয়ম। শিক্ষক তাই করেছেন।’
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
আমার পোস্টের পরে অনেকে ইনবক্স-এ লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন। এদের মধ্যে একটি পয়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল ‘যদি অরিত্রির বাবা-মা’র কেউ সামাজিকভাবে খ্যাতিমান বা এমপি-মন্ত্রী হত, তাহলে কি তাকে টিসি দেয়া হত?’ শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি এর আগে বহু নকলের ঘটনা চেপে গিয়েছে বলেও অনেকের অভিমত। অতএব যতটা সরল ভাবছি, ঘটনা আসলে এতটা সরল না, সাধারনও না। ভিকারুন্নেসার অধ্যক্ষকে ফাঁসি দিয়ে দিলেন আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এটা ভাবাও আমার কাছে এ মুহুর্তে বুদ্ধিমানের কথা মনে হচ্ছে না।
এই যে শিক্ষকরা, যাদের হওয়ার কথা ছিল অভিভাবক, তারা কেন প্রশাসক হলেন? উত্তর খুব সিম্পল, যে অধ্যক্ষকে একটু পরেই কোন বড় ব্যবসায়ী, মেয়র, আর্মির জেনারেল, এমপি, মন্ত্রী, সচিব ফোন করবে... তার ছেলে বা মেয়েকে অবৈধভাবে ভর্তি করার জন্য এবং ভর্তি করবেও, সে অধ্যক্ষ্যের আপনার আমার মত চুনোপুটিকে গুরুত্ব দেয়ার কি আছে? আর সে ভর্তি বানিজ্য করবেনাতো কে করবে???
ভিন্ন প্রসঙ্গঃ
ভিকারুন্নেসার মত স্কুলে অরিত্রিকে কেন নকল করতে হল? ভালো রেজাল্ট করতেই হবে, বেশি জিপেএ পেতেই হবে এ মানসিকতা কে তৈরি করে দিল? রেজাল্ট-ই সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিমাপক কেন হল? কেন আপনি ধরেই নিচ্ছেন, শুধু মাত্র বাবা-মায়ের অপমানের কারনে অরিত্রি আত্মহত্যা করেছে? কেন ধরে নিচ্ছেন না, সে নিজে যে সামাজিক হিউমিলেশানের মধ্যে পরেছে সেইটাও তার জন্যে অনেক বড় চাপ ছিল? অরিত্রির বাবা মায়ের কি দায় নাই? যদি এগুলো না হয়, তাহলে এটা ভেবে তৃপ্তি পেতে পারেন যে, আজকের ইয়ো ইয়ো প্রজন্মের এ বাংলায় আজো এমন ছেলে-মেয়ে বেঁচে আছে যারা বাবা-মার অপমানের জন্য আত্মহত্যা করে? জানেন কি? গত এক মাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮ জন আত্নহত্যা করেছে। প্রতি বছর পিএসসি ও জেএসসি’র ফলাফল ঘোষনার পরে অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করে ও করার চেষ্টা করে। প্রত্যেকটি আত্মহত্যাই যদি একেকটি হত্যা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের এ হত্যার দায় কার? কেন শিক্ষা ব্যবস্থাটা আজ এমন হয়ে গেল? সারা দেশে খোঁজ লাগান, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক শুধু মেধার যোগ্যতায় নিয়োগ পায়? কেন স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী পরেও একটা মানসম্মত ও গ্রহনযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা তৈরি করতে পারি নাই?
আসেন, মমতাজের গান শুনি---
মনে যদি পচন ধরে,
গন্ধ কিরে পাওয়া যায়।।
চোখে তারে যায়না দেখা,
মলম দিবি কোন জায়গায়।।
সিস্টেমে নজর দেন, সিস্টেম ঠিক না থাকলে অরিত্রিরা মরতেই থাকবে। আসুন, বিবেকের কাছে নিজকে দায়বদ্ধ করি।
*লেখার কিছু অংশ Zia ভাইয়ের স্টাটাস থেকে নেয়া।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

Comments